—ফাইল চিত্র।
ভাল রায় হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের ৯ সদস্যের বেঞ্চ গোপনতার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এই রায় নিয়ে কিছু বিভ্রান্তিও দেখা দিচ্ছে। অন্তত দু’টি বিষয় সর্বাগ্রে বলা দরকার।
প্রথমত, সুপ্রিম কোর্ট গোপনতার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে আজ প্রথম স্বীকৃতি দিল, এমনটা নয়। ১৯৭৮ সালেও সুপ্রিম কোর্টের এক বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ঘোষণা করেছিল, গোপনতার অধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদই এই অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, গোপনতার অধিকার মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও এই অধিকার অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। সামাজিক এবং জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই গোপনতার অধিকারের সীমা থাকা উচিত।
প্রথম প্রসঙ্গে আসা যাক। অর্থাৎ, গোপনতার অধিকারকে এর আগেও কী ভাবে সুপ্রিম কোর্ট কবে কী ভাবে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তা এক বার জেনে নেওয়া যাক। গোপনতার অধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার কি না, তা নিয়ে বিতর্ক প্রথম বার দানা বাধে খড়ক সিংহের মামলাকে কেন্দ্র করে। সেটা ৬০-এর দশকের মামলা। পুলিশ কনস্টেবল ছিলেন খড়ক সিংহ। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কারণে তাঁর উপর কঠোর নজরদারি চালানো শুরু হচ্ছিল। খড়ক সিংহ এই নজরদারির বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হন। এই নজরদারিতে তাঁর গোপনতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে তথা মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ খড়ক সিংহ মামলার বিচার করছিল, সেই বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য কিন্তু গোপনতার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। শুধু বিচারপতি সুব্বা রাও গোপনতাকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদকে ঠিকমতো ব্যাখ্যা করলেই দেখা যাবে, গোপনতার অধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার— নিজের রায়ে এমনই লিখেছিলেন বিচারপতি সুব্বা রাও। কিন্তু বেঞ্চের অন্য সব সদস্য তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করায়, তাঁর রায় গ্রাহ্য হয়নি।
আরও পড়ুন: ফের ঐতিহাসিক রায়: ব্যক্তিগত গোপনতা এখন মৌলিক অধিকার
১৯৭৮ সালে কিন্তু গোপনতার অধিকার সংক্রান্ত বিতর্ক নতুন মাইলফলকে পৌঁছে গিয়েছিল। সম্ভবত, সাত সদস্যের একটি বেঞ্চ সে বছর গোপনতার অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে রায় দিয়েছিল। সেই বেঞ্চের অধিকাংশ সদস্যই জানিয়েছিলেন, ৬০-এর দশকে বিচারপতি সুব্বা রাও যে রায় দিয়েছিলেন, সেটাই ঠিক রায় ছিল। অনুচ্ছেদ ২১-এর সবিস্তার ব্যাখ্যা দিয়ে বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য জানিয়েছিলেন, গোপনতা নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
২৪ অগস্ট, ২০১৭ ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ৯ সদস্যের বেঞ্চ আবার সেই কথাই বলল। ১৯৭৮ সালে যে রায় হয়েছিল, তাকেই আরও স্পষ্ট করে উচ্চারণ করল সুপ্রিম কোর্টের ৯ সদস্যের বেঞ্চ। ১৯৭৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গোপনতাকে মৌলিক অধিকার বলেছিল। এ বার আরও বড় বেঞ্চ সেই একই কথা বলল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়, সর্বসম্মতির ভিত্তিতে বলল।
আমাদের আলোচনায় দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, গোপনতার অধিকার অনিয়ন্ত্রিত বা অপরিমিত হতে পারে কি না। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, শুধু গোপনতার অধিকার নয়, কোনও মৌলিক অধিকারই অনিয়ন্ত্রিত বা অপরিমিত হতে পারে না। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে, অপরাধ দমনের স্বার্থে, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার তাগিদে রাষ্ট্রকে প্রতিনিয়ত নানা রকমের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। তার জন্য অনেকের গতিবিধির উপরেই নজরদারি চালানোর দরকার পড়ে। দেশের সিংহভাগ নাগরিককে নিরাপদে রাখতে, কোনও কোনও নাগরিকের কার্যকলাপে বা ব্যক্তিগত পরিসরে অনেক সময় রাষ্ট্রকে উঁকি দিতে হয়। সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থেই সেই অধিকার রাষ্ট্রের থাকা উচিত বলে আমার মনে হয়।
আরও পড়ুন: গোপনতার অবাধ অধিকার সম্ভব নয়, রায়কে স্বাগত জানিয়ে কেন্দ্র
আধার কার্ড নিয়েও সম্প্রতি বিতর্ক চলছে। আধার কার্ড আমাদের গোপনতার অধিকারকে খর্ব করছে বলে অনেকে দাবি করছেন। সেই মামলা এখন বিচারাধীন। সুপ্রিম কোর্টেরই একটি পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ মামলাটির বিচার করছে। আজ সুপ্রিম কোর্ট খুব স্পষ্ট করে জানাল, গোপনতার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। তা হলে কি এ বার সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ আধার কার্ড বাতিল করে দেবে? বা আধারের উপরে কি বিধিনিষেধ আরোপিত হবে? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য রায় ঘোষণার অপেক্ষায় থাকতে হবে আমাদের। কিন্তু রায় দেওয়ার আগে বিচারপতিদের মাথায় রাখা উচিত যে কোনও মৌলিক অধিকারই অপরিসীম হতে পারে না। আধার যে হেতু একটি জরুরি ব্যবস্থা, সে হেতু শুধু গোপনতার অধিকারের দোহাই দিয়ে একে বাতিল করা খুব যৌক্তিক সিদ্ধান্ত সম্ভবত হবে না।
সুপ্রিম কোর্ট আজ যে রায় দিল, তার সঙ্গে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার একটা বিরোধ কিন্তু রয়েছে। ৩৭৭ ধারায় সমকামিতাকে ফৌজদারি অপরাধ বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত গোপনতার অধিকারকে যদি নাগরিকের মৌলিক অধিকার বলে মেনে নিই, তা হলে নাগরিকের যৌন জীবনে আমরা উঁকি দিতে পারি না। যৌনতা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিষয়, গোপনীয় বিষয়ও। প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক কী ধরনের যৌন সঙ্গম করবেন, কার সঙ্গে যৌন সঙ্গম করবেন, তা নির্ধারণ করার অধিকার একমাত্র তাঁরই। নাগরিকের জীবনের সেই গোপন পরিসরে উঁকি দেওয়ার কোনও অধিকার রাষ্ট্রের নেই।
সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়েই দেশে এখনও ৩৭৭ ধারা বহাল রয়েছে। কিন্তু সেই রায় সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। ওই রায়ের পুনর্বিবেচনা হওয়া উচিত।
(লেখক সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি)