ধনীরাম মিত্তল। ছবি: এক্স।
প্রতারণার ইতিহাসে একটা যুগের অবসান হল দেশে। দিল্লির নিগমবোধ শ্মশানঘাটে দাঁড়িয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার এক অফিসার ৮৫ বছর বয়সি ধনীরাম মিত্তলের শেষকৃত্য নিজের চোখে দেখার পরে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন শনিবার। না হলে বলা তো যায় না, কী থেকে কী হয়ে যায় ফের!
বহুমুখী প্রতিভা ছিল ধনীরামের। আর তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ছিল পেশা এবং নেশা। অগ্রসূরী নটবরলাল থেকে হালের সুকেশ চন্দ্রশেখর, তাঁর তুলনা অনেকের সঙ্গেই হয়েছে। চর্চিত হয়েছেন হিন্দি ছবির বিভিন্ন চরিত্রের তুল্যমূল্যে। কিন্তু ‘চপস্টিক’-এর অভয় দেওল বা ‘ফর্জ়ি’-র শাহিদ কপূর— গল্পের কোনও ‘আর্টিস্ট’ এই প্রতারণা শিল্পীর তুলনা কোনও দিন জানবে না।
নথি জালিয়াতি, আর্থিক প্রতারণা থেকে শুরু করে হরেক কিসিমের অভিযোগ রয়েছে ধনীরামের বিরুদ্ধে। জীবনভর সবচেয়ে ধারাবাহিক ছিলেন গাড়ি চুরিতে। অবশ্য সেই পরিচয়েও তল মেলে না তাঁর। একটা সময়ে তাঁর উৎপাতে জেরবার হয়ে থাকা দুঁদে সব পুলিশকর্তারাও বলে থাকেন, ধনীরাম ছিলেন এক জন চমৎকার গল্প-বলিয়ে। বস্তুত, নটে গাছ মুড়োনোর পরে সেই কথকের পরিচয়টুকুই ধনীরাম ফেলে রেখে গিয়েছেন।
১৯৬৪ সাল। ধনীরামের বয়স ২৫ বছর। হরিয়ানার রোহতকের কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক। আর পাঁচ জন যুবকের মতো সরকারি চাকরির চেষ্টায় ঘুরে ঘুরে হাল ছেড়েছেন। ইতস্তত ঠোক্কর খেতে খেতে চলেছেন জীবন যেমন নিয়ে যাচ্ছে। এ ভাবেই এক দিন ঘটনার স্রোতের টানে ধনীরাম এসে ঠেকেন আঞ্চলিক পরিবহণ দফতরে। লক্ষ করেন দালালদের প্রবল রমরমা, এখনকারই মতো। সেই তাঁর শুরু। লাইসেন্স জালিয়াতি দিয়ে।
নিয়োগে দুর্নীতির যে সমস্ত নজির ধনীরাম গড়েছেন, তা আজকের এই জমানাতেও লোক বিশেষে শিক্ষণীয় বা ঈর্ষণীয় হতে পারে। নথি জালিয়াতি বছর চারেক করে হাত পাকিয়ে নেন। তার পরে প্রথম সরকারি চাকরিতে যোগ। রেলের স্টেশন মাস্টারের পদে। অবশ্যই, সমস্ত নথি ছিল জাল, নিজের হাতে তৈরি করা। বছর চারেক যেতে না যেতেই আর মন টেকেনি সেখানে। ধনীরাম যান দিল্লি। শুরু হয় নতুন অধ্যায়। গাড়ি চুরির।
এত গাড়ি চুরি করেছেন ধনীরাম, যার ইয়ত্তা নেই। এবং সব ক’টি চুরি দিনের আলোয়। গাড়ির নথি জাল করা তাঁর বাঁ-হাতের খেল! চলছিল দিব্যি। জেলে যেতে হচ্ছিল বটে মাঝেসাঝে, তবে সয়ে গিয়েছিল। বরং ধনীরামের ফের মনে হয়েছিল, শেখার শেষ নেই। এ বার উকিলদের দেখে। সুতরাং চুরি-জালিয়াতির থেকে ছুটি নিয়ে নাম লেখান রাজস্থানের জয়পুরের আইন-কলেজে। এলএলবি পাশ করে ভর্তি হন হস্তরেখা-বিদ্যার তালিম নিতে। আইনব্যবসায় যাওয়ার সাধ ছিল না তাঁর। এই বিদ্যা রপ্ত করলে প্রতারণার পথে উন্নতি আছে বুঝেই পড়তে যাওয়া! সুতরাং, ধনীরাম ফিরে আসেন সাবেক পেশায়, ওস্তাদ হয়ে।
এ বার ধনীরামকে হাতে পেলেও বাগে রাখা একটা ঝকমারি হয়ে ওঠে পুলিশের। আইনের ঘাঁতঘোঁত তাঁর ভালমতোই জানা। প্রত্যাশিত উন্নতিও হচ্ছিল বেশ। কিন্তু শিল্পীর মন, সে প্রতারণাশিল্পীর হলই বা, এক জায়গায় টিকলে তো! ধনীরামের চোখ পড়ে কাগজের খবরে। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় হরিয়ানার ঝজ্জরের এক জন অতিরিক্ত দায়রা বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। ভিওয়ান জেলায় বাড়ি ছিল ধনীরামের। যেতেন কখনও সখনও। দিল্লির চুরি-জালিয়াতির খবর সে যুগে ওই পর্যন্ত পৌঁছত না। আর ঝজ্জর সেখান থেকে বিশেষ দূর নয়।
কিছু দিনের মধ্যেই হাই কোর্টের রেজিস্ট্রারের নামে দু’টি চিঠি রওনা হয় ডাকে। প্রথমটি পান সেই বিচারক। তাতে লেখা, যত দিন তদন্ত চলবে কোর্টে আসার দরকার নেই। অন্যটি পরের দিন ঝজ্জরের আদালতে আসে ওই বিচারপতির বদলি হিসেবে আর এক জনের নিয়োগ-সংবাদ নিয়ে। এবং অচিরেই নতুন বিচারকের ভেক ধরে আবির্ভাব হয় ধনীরামের। চল্লিশ দিন বসেছিলেন এজলাসে। প্রায় ২৪৭০টি মামলা শুনেছেন। জামিন দিয়েছেন প্রায় দু’হাজার জনকে। ধর্ষণ বা খুনের মতো কিছু মামলা ছাড়া সমস্ত ক্ষেত্রেই জামিন মঞ্জুর হয়ে যেত ধনীরামের এজলাসে। বিচারপতি দয়ালু না জাল, তা নিয়ে জল্পনা যখন তুঙ্গ ছুঁচ্ছে, হঠাৎ এক দিন ধনীরাম হাওয়া।
তার পরে গাড়ি চুরির অভিযোগে ধরাও পড়েন ধনীরাম। লেগেই ছিল জেলে গতায়াত। নকল চাবি দিয়ে গাড়ির দরজা খোলার সময় ধরা পড়ে গেলে বা পুলিশের জেরার মুখে, নানা সময়ে নিজের বার্ধক্য শিল্পীজনোচিত ভাবেই ব্যবহার করে গিয়েছেন। তাঁর ৯৫তম এবং শেষ গ্রেফতার হওয়া ২০১৬ সালে। ৭৭ বছর বয়সে। দিল্লির পঞ্জাবি বাগে গাড়ি চুরির অভিযোগে। তত দিনে উঠতি প্রতারকদের পূজ্যপাদ তিনি। ধনীরামের সাক্ষাৎ পাওয়ার আশায় কেউ কেউ ছোটখাট অপরাধ করে জেলেও গিয়েছিল সাধ করে।
গত বছর চণ্ডীগড়ের এক মামলায় অল্প কিছু দিন সাজা খেটে জেল থেকে বেরিয়ে ধনীরাম পরিচিত হয়ে যাওয়া তদন্তকারী অফিসারকে বলেছিলেন, এত দিন পরে এ বার ক্লান্ত লাগছে। তার কিছু দিনের মধ্যেই স্ট্রোক। এবং পক্ষাঘাত। বহস্পতিবার ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে ধনীরামের। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে।
এখনও তাঁর বিরুদ্ধে বিচারাধীন গোটা পঁচিশ মামলা। সেগুলির ইতি এক প্রকার নিজের হাতেই টেনে দিয়ে গেলেন ধনীরাম, মৃত্যুতে।