বানভাসি মুম্বই। ছবি: পিটিআই।
একের পর এক ফোন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে সাহায্য চেয়ে পোস্ট। না, কেউ আসতে পারেননি। স্বামীও নয়।
কী করেই বা আসবেন, রেল লাইনের উপর কোমর-জল। দুপুর গড়িয়ে সন্ধে নেমেছে কখন। দিনভর যে গুটিকয় সাহায্যের মুখ দেখা যাচ্ছিল রেললাইনের আশপাশে, অন্ধকার নামতে সেই মুখগুলোও উধাও। বারবার ফোন করতে গিয়ে ফুরিয়ে এসেছিল মোবাইলের চার্জও। এ অবস্থায় সাত মাসের সন্তানসম্ভবা ঊর্মিলা দেঠের সঙ্গী ছিল শুধু অসহায় কতগুলো মুখ।
একটি মরাঠি দৈনিকের সাংবাদিক ঊর্মিলা। খবরের খোঁজে বম্বে হাইকোর্ট যাচ্ছিলেন। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ মুম্বইমুখী ডোম্বিভলীর ট্রেনে ওঠেন। তখনও জানতেন না তিনি, ঘণ্টাখানেকের রাস্তা শেষ হবে বারো ঘণ্টায়।
সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা বলে ভিড় এড়াতে প্রতিবন্ধী কামরাতে উঠেছিলেন ঊর্মিলা। বললেন, ‘‘২০ জন সহযাত্রী। তার মধ্যে আট দৃষ্টিহীন প্রতিবন্ধী আবার জানালেন, ঘটনাচক্রে ২০০৫-এর ২৬ জুলাইও তাঁরা ট্রেনে ছিলেন। গোটা রাতটা ট্রেনেই কাটাতে হয়েছিল তাঁদের।’’
এ বারেও কি তাই হবে? কপালে কী আছে কে জানে, সাত-পাঁচ ঘুরছিল ঊর্মিলার মাথায়। সারা দিন ট্রেনের ওই ছোট্ট কামরাটাতে যা একটু হাঁটাচলা। খাওয়া নেই বললেই চলে। ‘‘আমাদের ট্রেনটা কুর্লা ও সায়নের মাঝখানে আটকেছিল। দুপুরে বহু জনকে ফোন করে সাহায্য চাই। টুইটও করি। একটা সময়ে আশপাশের মুখগুলোকে দেখে মায়া হয়। নিজেরই মনে হয়, একটু ধৈর্য ধরে বসি,’’ বললেন ঊর্মিলা। শুরু হয় অনন্ত অপেক্ষা।
আরও পড়ুন: পানাগড়িয়ার বিদায়ী তোফায় বিদ্ধ মোদী
এ দিকে, অনেক চেষ্টা করেও দমকল কিংবা মুম্বই পুলিশ পৌঁছতে পারেনি। ঊর্মিলার স্বামী বান্দ্রা শহরতলিতে কাজ করেন। বেশ কয়েক বার চেষ্টা করে তাঁকে ফোনে পান স্ত্রী। কিন্তু জলমগ্ন রাস্তা ও ভয়াবহ যানজট ঠেলে ঘটনাস্থলে পৌঁছনোই যে অসম্ভব!
এরই মধ্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন রেললাইনের আশপাশে থাকা লোকজন। খাবার-পানীয় জল যা একটু পেটে পড়েছিল, তাঁদেরই সৌজন্যে, জানালেন ঊর্মিলা। কিন্তু রাত নামতেই সেই মানুষগুলোও ফিরে যান। ইতিমধ্যে কে যেন খবর দেয়, কালভার্টে পড়ে গিয়েছিল এক কিশোর। ট্রেনেরই কোনও এক যাত্রী গলা-জল থেকে তাকে উদ্ধার করেছেন। এ সব নিয়ে ভাবতে-ভাবতেই হঠাৎ বেজে ওঠে ঊর্মিলার ফোন। ও-পারে মুম্বইয়ের বিজেপি প্রধান আশিস শেলার। ‘‘ওঁর কথা শুনে একটু ভরসা হয়,’’ বললেন তিনি। কিন্তু ফোনের চার্জ ক্রমশই শেষ হয়ে আসছিল।
ঘড়িতে তখন ১১টা ৫৫। কামরার বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই চোখে পড়ে দমকলের সিঁড়িটা। তার পরই একটা হাত, ইশারা করছে এগিয়ে আসার জন্য। ‘‘এক ফোঁটা জলও গায়ে লাগতে দেননি ওঁরা। একটা বাচ্চার মতো কোলে করে নিয়ে গিয়েছেন। কী যে বলব...,’’ কান্নাভেজা গলায় বললেন ঊর্মিলা।
মঙ্গলবার মুম্বইয়ের এই বন্ধুত্বপূর্ণ ছবিটা অবশ্য দেখেছেন অনেকেই। মুম্বইয়ের একটি এলাকায় জল-পথে আটকে পড়া মানুষজনকে চা-বিস্কুট খাইয়েছেন বস্তিবাসীরা। মহারাষ্ট্রের সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী গিরীশ বাপট আবার ফেসবুকে লেখেন, ফোর্ট কিংবা মন্ত্রালয়ের কাছে কেউ আটকে পড়লে তাঁর বাসভবন ‘ধ্যানেশ্বরী’তে আশ্রয় নিতে পারেন। শুধু তিনি-ই নন, এ ভাবে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বহু সাধারণ মুম্বইবাসীই।