লাভ-ক্ষতির অঙ্কে জোটের খাতায় শূন্য!
ভোটের আর কুড়ি দিনও বাকি নেই মহারাষ্ট্রে। বড় কথা, পরশু মনোনয়নপত্র পেশের শেষ দিন। তার আগেই আজ নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে গেল মরাঠা রাজনীতিতে। আসনরফা নিয়ে বনিবনার অভাবে শিবসেনার সঙ্গে আড়াই দশকের জোট ভেঙে দিল বিজেপি। ভাঙন শাসক জোটেও। শিবসেনা-বিজেপি বিচ্ছেদের ছবি স্পষ্ট হতেই বিধানসভা ভোটে একলা চলার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দিল শরদ পওয়ারের এনসিপি। এমনকী, রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে রাজ্যের জোট সরকার থেকে রাতারাতি সমর্থনও তুলে নিল পওয়ারের দল।
আপাতত এর অর্থ একটাই। মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা বা রাজ ঠাকরের সঙ্গে বিজেপি কিংবা শিবসেনার আঁতাঁত না হলে এ বার পাঁচমুখী ভোট হবে মরাঠা মুলুকে। সে ক্ষেত্রে কোনও একটি দলের একক গরিষ্ঠতা অর্জনের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল আজ থেকেই। ভোটের পরে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে নতুন কোন সমীকরণ তৈরি হবে, এনসিপি-বিজেপি কাছাকাছি আসবে কি না, এ সব নিয়েও শুরু হয়ে গেল জল্পনা।
ভোটের পরে কী হবে, সে পরের কথা, এই মুহূর্তে মূল কৌতূহলের বিষয় এটাই যে, এমন ঘটল কেন?
মহারাষ্ট্রে ১৫ বছর ধরে একটানা সরকার চালাচ্ছে কংগ্রেস-এনসিপি জোট। ফলে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়া থাকাটা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। এবং তা যথেষ্ট পরিমাণেই রয়েছে এই সরকারের বিরুদ্ধে। তার ওপর সম্প্রতি লোকসভা ভোটে গোহারা হয়ে কার্যত মাজা ভেঙে গিয়েছে দুই শাসক দলেরই। এই অবস্থায় অনেকে ধরেই নিচ্ছিলেন, বিধানসভা ভোটে চোখ বুঁজে জিতবে বিজেপি-শিবসেনা জুটি। কিন্তু বাইরে থেকে যা সহজ দেখাচ্ছিল, ভিতরে ভিতরে তারই মধ্যে ছিল আকাঙ্ক্ষা আর আশঙ্কার অনেক পরত। মহারাষ্ট্রে এক সময় বিজেপির চেয়ে বড় দল ছিল শিবসেনা। কিন্তু বালসাহেব ঠাকরের মৃত্যুর আগে থেকেই শিবসেনা দুর্বল হতে শুরু করেছিল। তাঁর ছেলে উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিভিন্ন মহলে। এই অবস্থায় উদ্ধব ভেবেছিলেন, বিজেপির সঙ্গে আসনরফার সময়েই মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবি জানিয়ে মরাঠা রাজনীতিতে নিজের কর্তৃত্ব সুনিশ্চিত করে ফেলবেন। তাই গোড়া থেকেই এ বার বেশি আসনের দাবিতে সরব ছিলেন তাঁরা। শিবসেনার আশঙ্কা ছিল, বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নির্বাচিত হলে মুখ্যমন্ত্রীর পদ কোনও মতেই ছাড়বে না। তার ওপর নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা ক্রমশই শিবসেনার জমি গ্রাস করে নেবেন।
সিকি শতকের সম্পর্ক ছেদের মূল কারণ যে এটাই, তা আজ সন্ধেয় পরিষ্কার হয়ে যায় বিজেপির কথাতেই। ২২ দিন ধরে শিবসেনার সঙ্গে দর কষাকষির পর আজ আমেরিকা যাওয়ার ঠিক আগে জোট ভাঙায় সম্মতি দেন প্রধানমন্ত্রী। তার পরেই সাংবাদিক বৈঠক করে বিজেপি জানিয়ে দেয়, উদ্ধবের মুখ্যমন্ত্রী হতে চাওয়াই জোট ধরে রাখার পথে প্রধান অন্তরায় ছিল। তা ছাড়া আসন বণ্টনের যে সূত্র শিবসেনা দিচ্ছে, বিজেপি ও ছোট দলগুলির পক্ষে তা মানা সম্ভব নয়।
তবে এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, জোট রাখতে এটুকু আপস কেন করল না বিজেপি? কোন অঙ্ক কষে ভোট ভাগাভাগির ঝুঁকি নিলেন মোদী-অমিত? বিজেপি সূত্র জানাচ্ছে, এই সিদ্ধান্ত সুচিন্তিত। দলের নিজস্ব সমীক্ষা জানাচ্ছে, রাজ্যে সরকার-বিরোধী হাওয়া এতই তীব্র যে, বিজেপি একা লড়েও ১২০টি আসন পেতে পারে। ২৮৮টি আসনের বিধানসভায় সরকার গড়তে দরকার অন্তত ১৪৫ জন বিধায়ক। ১২০টি আসন একার ক্ষমতায় পেয়ে গেলে তার পরে ছোট দলের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়তে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। এ জন্য তলে-তলে রাজ ঠাকরে, এমনকী এনসিপি-র সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে বিজেপি।
অমিত শাহদের মতে, ভোটের পরে শিবসেনা ফের শরিক হলেও তখন আর মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবি তুলতে পারবে না। বরং ভোটে একক-গরিষ্ঠ দল হিসেবে নির্বাচিত হলে সরকার গড়ার জন্য প্রথম ডাক পাবে বিজেপিই। সে ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী বিজেপিরই হবে। দেশের আর্থিক রাজধানীর ক্ষমতা দখলের জন্য যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কেন্দ্রে মোদী যে ভাবে সরকার চালাতে চাইছেন, তাতে মুম্বইয়ের ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখা দরকার। এই প্রসঙ্গেই বিজেপি নেতাদের এখনও আফসোস, গোপীনাথ মুন্ডের অকালমৃত্যু না হলে উদ্ধব এতটা সাহস দেখাতে পারতেন না, জোটও অটুট থাকত।
বিরোধী ভোট ভাগাভাগি হলে শাসক জোটেরই লাভ। রাজনীতির সহজ সূত্র এটাই। বিরোধী-জোটে ভাঙন ধরা সত্ত্বেও কেন ভেঙে গেল শাসক জোট? ভোট-রাজনীতির সেই অঙ্কটাও কম আকর্ষণীয় নয়।
কংগ্রেস নেতৃত্ব জানাচ্ছেন, আসলে রাহুল গাঁধী অনেক আগে থেকেই মহারাষ্ট্রে একা লড়ার দিকে ঝুঁকে ছিলেন। তাঁর মতে এ বার জোট হলেও ভোটে খুব ভাল করার সম্ভাবনা ছিল না কংগ্রেসের। বরং একা লড়ার কিছু সুবিধা রয়েছে। মহারাষ্ট্রে শাসক জোটের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়ার মূল কারণ হল দুর্নীতি। কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ, উপমুখ্যমন্ত্রী অজিত পওয়ার-সহ এনসিপি নেতারাই বেশি দুর্নীতিপরায়ণ। তাঁদের বিরুদ্ধেই মানুষের রাগ বেশি। তাই আলাদা লড়লে এনসিপি-র বোঝা বইতে হবে না কংগ্রেসকে। বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বাণের ব্যক্তিগত সততা যেখানে প্রশ্নাতীত। এ জন্য পৃথ্বীরাজ নিজেও গোড়া থেকেই জোটের বিরোধী ছিলেন। তা ছাড়া, রাহুলের মত হল, পরাজয়ের জন্য মানসিক প্রস্তুতি যখন দলের রয়েছেই, তখন ঝুঁকি নিয়ে দেখা যাক। তাতে অন্তত দেড় দশক পর মহারাষ্ট্রের সব আসনে প্রার্থী দিতে পারবে কংগ্রেস। রাহুল-অনুগামীদের যুক্তি, মহারাষ্ট্রে কংগ্রেসই একমাত্র দল গোটা রাজ্যে যাদের সংগঠন ও বাঁধা ভোটার রয়েছে। তাই চার বা পাঁচমুখী ভোট হলে আশ্চর্যজনক ভাবে সুবিধা পেয়ে যেতে পারে কংগ্রেস।
জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস কিছুটা চাপের মধ্যে থাকায় এ বার মুখ্যমন্ত্রীর পদ নিয়ে দর হাঁকাচ্ছিল এনসিপি-ও। তাঁদের দাবি ছিল, ভোটের আগেই কংগ্রেসকে মুচলেকা দিতে হবে যে মুখ্যমন্ত্রীর পদ আড়াই বছর করে ভাগ করতে হবে দু’দলের মধ্যে। কিন্তু কংগ্রেস তা মানতে রাজি হয়নি। তা ছাড়া বিজেপি-শিবসেনার জোট ভাঙার সম্ভাবনা দেখে কিছুটা হাপিত্যেশ করেছিলেন অজিত পওয়ারও। কারণ, তলে-তলে তাঁদের এ-ও ইচ্ছা যে ভোটের পর মওকা বুঝে প্রয়োজনে বিজেপির হাত ধরে সরকারেই থেকে যাবে এনসিপি।
এই পরিস্থিতিতে পরশু রাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ভোটের আগে বিচ্ছেদ ঘটবে কংগ্রেস-এনসিপি-র। কাল একতরফা ভাবে ১১৮ জন প্রার্থীর নামও ঘোষণা করে দেয় কংগ্রেস। অপেক্ষা ছিল শুধু বিরোধী- জোট ভাঙার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার। সেটা হতেই, কংগ্রেস আজ একলা চলার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়।
তবে রাজনীতিকরা অনেকেই কিন্তু এখনও মনে করছেন, খেলা শেষ হয়নি। মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিন পর্যন্ত তা চলবে। বিশেষ করে জোট ভাঙার এই ঘোলা জলে এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বালসাহেবের চৌখস ভাইপো রাজ ঠাকরের ভূমিকা।