KD Singh

দেশজ রাজনীতির সৌরমণ্ডলে কেডি হলেন আধুনিক মগনলাল মেঘরাজ

রিমলেস চশমা, ম্যানিকিওর করা হাতের নখ, নিজস্ব চাটার্ড বিমান— কেডি হলেন আক্ষরিক অর্থেই ভারতীয় রাজনীতির ‘মগনলাল মেঘরাজ’।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২১ ১৮:১৭
Share:

হিমাচলপ্রদেশে তৃণমূলের প্রচারে গিয়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে ছিলেন দলের দুই নেতা। চণ্ডীগড়ে বিমান থেকে নামার পর তাঁদের শিমলা নিয়ে গিয়েছিল এক পেল্লায় ‘সেডান’। থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল বিলাসবহুল হোটেলে। প্রচারে যেতেন হাই এন্ড এসইউভি-তে চেপে। বক্তৃতা সেরে মঞ্চ থেকে নেমে গাড়িতে ওঠার পর কোল্ড কেস থেকে সুগন্ধী এবং ঠান্ডা ছোট তোয়ালেতে ঘাড়-গলা মুছে নিয়ে ক্লান্তি অপনোদন। আতিথেয়তায় গদগদ দুই নেতা কলকাতায় দলের সতীর্থদের ফোন করে তাঁদের উচ্ছ্বাসের কথা জানাতেন রোজ।

Advertisement

তৃণমূলের দুই নেতার নির্বাচনী প্রচারের সেই সফরে পুরো ব্যবস্থাপনায় ছিলেন কুঁয়ারদীপ (কুমারদীপ) সিংহ। আসমুদ্রহিমাচল যাঁকে চেনে ‘কেডি’ নামে। যে কেডি-কে বুধবার দিল্লি থেকে গ্রেফতার করল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। আদালতে তোলার পর যাঁকে আগামী শনিবার পর্যন্ত ইডি-র হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

চকচকে পোশাক, পায়ে দামি মোকাসিন, রিমলেস চশমা, ম্যানিকিওর করা হাতের নখ, নিজস্ব চাটার্ড বিমান— কেডি হলেন আক্ষরিক অর্থেই ভারতীয় রাজনীতির ‘মগনলাল মেঘরাজ’। শুধু কাশীর অলিগলিতে তাঁর বিচরণ নয়। তাঁর বিচরণ ভারতীয় রাজনীতির সৌরজগতে। এমনকি, তাঁর টুব্রো ফিনান্স গ্রুপের কারখানার উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও। ঘটনাচক্রে, তৃণমূলের সাংসদ হলেও কেডি-র কোনও কারখানা বা প্রকল্পের উদ্বোধনে দেখা যায়নি বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

Advertisement

ইডি-র খাতার প্রায় ২০০ কোটি টাকা প্রতারণায় অভিযুক্ত প্রাক্তন রাজ্যসভা সাংসদ কেডি-র বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ কিন্তু বেশ কয়েক বছরের পুরনো। রাজ্যসভার নথি জানাচ্ছে, ১৯৬১ সালের ২১ অগস্ট পঞ্জাবের ফতেগড় সাহিবে তাঁর জন্ম। পাটিয়ালার পঞ্জাবী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবিভাগের স্নাতক ডিগ্রির পাশাপাশি আপাতত ৫৯ বছরের কেডি-র ঝুলিতে রয়েছে ব্রিটেনের অ্যাংগলিয়া রাস্কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ডক্টরেট ডিগ্রিও। কেডি-র স্থায়ী ঠিকানা চণ্ডীগড়ের অভিজাত এলাকা সেক্টর ৯-বি। স্ত্রী-র নাম হরপ্রীত কৌর। দুই পুত্রসন্তানের জনক তিনি।

২০১০ সালের জুলাই মাসে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার টিকিটে প্রথম বার রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছিলেন কেডি। অবশ্য তার আগেই দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের জমানায় কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা ‘ন্যূনতম পারিশ্রমিক সংক্রান্ত পরিষদ’-এর চেয়ারম্যান হয়েছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে জিতে দ্বিতীয় বার রাজ্যসভার সাংসদ হন। সে বার তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে। জনশ্রুতি: কেডি-কে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে নিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন তৃণমূলের দু’নম্বর মুকুল রায়। যে কারণে বুধবার কেডি গ্রেফতার হওয়ার পর অধুনা তৃণমূলের মুখপাত্র এবং রাজ্যসভারই প্রাক্তন সাংসদ কুণাল ঘোষ কালবিলম্ব না-করে মুকুলকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন।

সংসদে তৃণমূলের প্রতিনিধি হিসেবে পরিবহণ, পর্যটন ও অসামরিক বিমান পরিবহণ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন কেডি। কিন্তু নারদ গোপন ক্যামেরা অভিযানের পরে ২০১৬ সালে তৃণমূলের তরফে লোকসভার স্পিকার এবং রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে চিঠি লিখে তাঁকে ওই দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছিল। বস্তুত, কেডি ‘তহেলকা’ নামক সংবাদমাধ্যমের অন্যতম মালিক ছিলেন বলে বিভিন্ন সময়ে ‘খবর’ সামনে এসেছে। নারদ গোপন ক্যামেরা অভিযান (স্টিং অপারেশন) তাঁর নির্দেশেই হয়েছিল বলে প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন সংস্থার প্রাক্তন সিইও ম্যাথু স্যামুয়েল। নারদ-কাণ্ডে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে ম্যাথু দাবি করেন, ওই গোপন ক্যামেরা অভিযানের জন্য কেডি তাঁকে ৮০ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। সে অর্থে ম্যাথু ছিলেন মগনলালের ‘অর্জুন’। যিনি ১৩ নম্বর বাক্স থেকে বার করা ছুরির খেলা দেখিয়ে সামনের তক্তায় পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো প্রতিপক্ষকে বিবশ করে দিতে পারেন। কেডি অবশ্য বিষয়টি অস্বীকার করেন। যদিও তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই ২০১৯ সালে নারদ-কাণ্ড নিয়ে জেরা করেছিল কেডি-কে।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে প্রকাশ্যে আসা সেই গোপন ক্যামেরা অভিযানে তৃণমূলের বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রীকে হাত পেতে নগদ টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল। যদিও ভোটে তার কোনও প্রভাব পড়েনি। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছিলেন মমতা। কিন্তু কেডি ততদিনে তৃণমূলে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছেন। যদিও খাতায়কলমে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি তৃণমূলেরই রাজ্যসভা সাংসদ ছিলেন।

যে অ্যালকেমিস্ট গ্রুপের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ নয়ছয়ের কারণে কেডি-কে গ্রেফতার করল ইডি, তার সূত্রপাত ১৯৮৮ সালে। সেই বছরে টুব্রো ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানি খুলেছিলেন কেডি। তারপর ২০০৪ সালে ওই কোম্পানিরই নাম রাখেন অ্যালকেমিস্ট গ্রুপ। খেলাধুলোর জগতেও কেডি-র প্রশাসনিক পদচিহ্ন পড়েছে। দীর্ঘদিন তিনি যুক্ত ছিলেন ভারতীয় হকি ফেডারেশনের সঙ্গে। স্বাস্থ্যক্ষেত্র, আবাসন শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, চা শিল্প-সহ নানা ক্ষেত্রে দেশে এবং বিদেশে বিনিয়োগ রয়েছে কেডি-র। ‘কেএফসি’-র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে ‘রিপাবলিক চিকেন’ বাজারে এনেছিলেন কেডি।

কেডি-র সংস্থা অ্যালকেমিস্ট ইনফ্রা রিয়েলিটি গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সেবি-র নিয়ম লঙ্ঘন করে বাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ‘কালেক্টিভ ইনভেস্টমেন্ট স্কিম’-এর মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে তোলার। ২০১৩ সালে বিষয়টি সামনে আসে। পাশাপাশি, আর্থিক তছরূপ এবং নানা অভিযোগে সেবি, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এবং ইডি-র কাছে নির্দিষ্ট অভিযোগও জমা পড়ে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের অধীন ফিনানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে কেডি এবং তাঁর সংস্থার বিরুদ্ধে শুরু হয় তদন্ত। নিয়ম ভেঙে বিদেশে ১০ কোটি ডলার পাচারের অভিযোগে ২০১৮ সালের অগস্টে সেবি-র আবেদনের প্রেক্ষিতে ‘অ্যালকেমিস্ট’-এর যাবতীয় স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি কেনাবেচার উপর স্থগিতাদেশ জারি করেছিল কলকাতা হাইকোর্ট।

আরও পড়ুন: চেনটা ছিঁড়ে গেল, বকলসটা এখনও গলায় আটকে, বলছেন শিশির

মঙ্গলবার থেকেই তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে জেরা শুরু করেছিল ইডি। তিনি জেরায় ‘সহযোগিতা’ করেননি বলে অবশেষে বুধবার তাঁকে গ্রেফতার করে হেফাজতে নিল তদন্তকারী সংস্থা। এখন দেখার, হেফাজতে নিয়ে তাঁকে জেরা করে কী কী তথ্য যোগাড়ের চেষ্টা করে ইডি। এবং সেই তথ্য কী ভাবে কাজে লাগানো হয়।

আরও পড়ুন: আপাতত দল বড় করে পরে ছাঁকনি, নীলবাড়ির লক্ষ্যে এখন দিলীপ-নীতি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement