করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনার দৃশ্য। —নিজস্ব চিত্র।
আপ মেন লাইনে যাওয়ার জন্য সিগন্যাল সবুজ হয়ে থাকলেও, পয়েন্ট-এর (যার মাধ্যমে ট্রেন লাইন-পরিবর্তন করে) অভিমুখ খোলা ছিল লুপ লাইনের দিকে। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে প্রাথমিক তদন্তে এই তত্ত্ব উঠে আসতেই তোলপাড় দেশ। অথচ সিগন্যালিং ব্যবস্থায় এ ধরনের গন্ডগোলের চড়া মাসুল যে আগামী দিনে যে কোনও সময়ে দিতে হতে পারে, অন্তত চার মাস আগে সে বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন দক্ষিণ-পশ্চিম রেলের প্রিন্সিপাল চিফ অপারেশন ম্যানেজার হরিশঙ্কর বর্মা! ওই জ়োনের জেনারেল ম্যানেজারকে লেখা চিঠিতে সিগন্যালিং ও পয়েন্টের তালমিলের অভাবে প্রায় হতে যাওয়া একটি দুর্ঘটনার বিষয়েও বিশদে জানিয়েছিলেন তিনি। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এখন প্রশ্ন উঠছে, সময় থাকতে ওই সাবধানবাণী কানে না তোলারই কি খেসারত এতগুলি প্রাণ?
এই প্রশ্ন এখন ওঠার মূল কারণ, চার মাসে আগে জমা পড়া রিপোর্টে দুর্ঘটনার বিবরণের সঙ্গে করমণ্ডলের দুর্ঘটনার ‘মিল’। বর্মার রিপোর্ট অনুযায়ী, ৮ ফেব্রুয়ারি মাইসুরু ডিভিশনে ১২৬৪৯ আপ সম্পর্কক্রান্তি এক্সপ্রেস হোসদুর্গ স্টেশন ছাড়ার পরে আপ লাইনে যাওয়ার সিগন্যাল পান চালক। কিন্তু কিছুটা এগোতেই দেখতে পান, সিগন্যাল আপ লাইনে যাওয়ার জন্য সবুজ থাকলেও, পয়েন্ট ডাউন লাইনের দিকে খুলে রয়েছে। সে দিন সম্পর্কক্রান্তির চালক পয়েন্টের গন্ডগোল দেখেই ট্রেনটি দাঁড় করিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে ট্রেনের গতিবেগ কম থাকা ও চালক সতর্ক থাকার কারণে সম্পর্কক্রান্তির ডাউন লাইনে যাওয়া আটকানো সম্ভব হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, ওই লাইনে কয়েক মিনিট পরেই একটি মালগাড়ি আসার কথা ছিল। অর্থাৎ, সে দিন চালক সতর্ক না থাকলে, চার মাস আগেই করমণ্ডল এক্সপ্রেসের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনার সাক্ষী থাকত সারা দেশ।
শুক্রবার সন্ধ্যায় আপ করমণ্ডল এক্সপ্রেসের জন্য মেন লাইনে যাওয়ার সবুজ সিগন্যাল দেওয়া থাকলেও, পয়েন্ট খোলা ছিল লুপ লাইনের দিকে। যেখানে ঢুকে তা আছড়ে পড়ে ওই লাইনে আগেই দাঁড়িয়ে থাকা লৌহ আকরিক বোঝাই মালগাড়িতে।
এই রিপোর্টের ভিত্তিতে কংগ্রেসের মুখপাত্র পবন খেড়ার বক্তব্য, ‘‘চার মাস আগে সতর্কবার্তা পাওয়া সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি রেল! কেন ওই রিপোর্ট ফেলে রাখা হয়েছিল, সেই জবাব দিতে হবে রেলমন্ত্রীকে। বিষয়টিকে রেল মন্ত্রক গুরুত্ব দিলে, আজ এত মানুষের প্রাণ যেত না।’’
রিপোর্টে বর্মা পর্যবেক্ষণে জানিয়েছিলেন, যে রকম স্বয়ংক্রিয় ভাবে পয়েন্ট ভুল অভিমুখে ঘুরে গিয়েছিল, তা থেকে স্পষ্ট যে, সিগন্যালিং ও পয়েন্ট ইন্টারলকিং ব্যবস্থার মধ্যে কোথাও বড় মাপের গলদ রয়েছে। কারণ, সিগন্যাল একটি লাইনে দেখানো ও আর পয়েন্টের অন্য লাইনের দিকে ঘুরে থাকা ইন্টারলকিং ব্যবস্থার পরিপন্থী। বর্মা জানিয়েছিলেন, দ্রুত এই সমস্যার কারণ চিহ্নিত না করলে, আগামী দিনে বড় মাপের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সেই আশঙ্কাই সত্যি হল।
করমণ্ডলের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সিগন্যালিং ব্যবস্থার ত্রুটি এ দিন মেনে নিয়েছেন রেল বোর্ড সদস্য (অপারেশন) জয়া বর্মা সিন্হা। তিনি বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে যা জানা গিয়েছে, তাতে সিগন্যালিং ব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়েছে। বিভিন্ন কারণে ওই ত্রুটি হতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে শর্ট সার্কিট, কোনও একটি পয়েন্টের সঙ্গে যুক্ত তারেরনেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। কয়েক জন লোককে চিহ্নিত করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে এর থেকে বেশি কিছু এখনই বলা যাবে না।’’
অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরে জয়া বর্মা বলেন, ‘‘কোনও সম্ভাবনাই এই মুহূর্তে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।’’ এ দিন সন্ধ্যায় দুর্ঘটনার তদন্তভার সিবিআইয়েরহাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অন্তর্ঘাত খুঁজে দেখার সম্ভাবনাকে আরও উস্কে দিয়েছে। সিগন্যালিং ব্যবস্থায় ওই গন্ডগোল ইচ্ছাকৃত নাকি প্রযুক্তিগত ত্রুটি, নাকি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই তা হয়েছে—করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার পরে এখন তা খুঁজে দেখছেন কমিশন অব রেলওয়ে সেফটির সদস্যেরা।
পারিপার্শ্বিক সব দিক বিচার করে আজ এই দুর্ঘটনার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। যদিও এ প্রসঙ্গে কংগ্রেসের অভিযোগ, নিজেদের দায় এড়াতে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের নেতৃত্বাধীন সিবিআইয়ের হাতে ওই মামলা তুলে দেওয়া হল। যাতে রেলের সব ধরনের ত্রুটির উপরে পর্দা টানা সম্ভব হয়।