অতিমারি এসে বাজারের অধঃপতনকে দ্রুত করেছে। প্রতীকী চিত্র।
তিনি পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। পড়ান কলকাতার কাছেই বিখ্যাত এক কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। স্ত্রীও একই প্রতিষ্ঠানে জীববিদ্যার অধ্যাপিকা। দুই সন্তানকে নিয়ে বাস করেন কল্যাণীতে। মাংসাশী বলে নিজের পরিচয় দিতেন। কিন্তু পরহিতে মাংস খেতে খেতে এখন ক্লান্ত। কারণ? বাজারের মাংসের দোকানের ছেলেটি প্রায়শই হাতেপায়ে ধরে মাংস দিয়ে যায় বিক্রি হয়নি বলে। এ বাজারে অত দামে মাংস কেনার লোক নেই। দোকানে ঝাঁপ ফেললে যাও বা দু-চার টাকা আসে তাও বন্ধ হয়ে যাবে। আর অন্য কোথায় কাজ মিলবে তাঁর এই বাজারে?
এই মুহূর্তে আমাদের সমস্যা কিন্তু এটাই। চাহিদার অভাব। হ্যাঁ। অতিমারি এসে বাজারের অধঃপতনকে দ্রুত করেছে। নীতি নির্ধারকদের হাতে বাঁচার ঢালও তুলে দিয়েছে। কিন্তু বৃদ্ধির চাকার গতি তো আজ নয়, কমতে শুরু করেছে প্রায় গত পাঁচ বছর ধরেই। আর বাজারের চাহিদা কমাই কিন্তু তার মূল কারণ। এগোনোর আগে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক ২০১৬ সাল থেকে আর্থিক বৃদ্ধির হারের পতনের উপর।
এ বার হাতে এসেছে চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকের আর্থিক ফল। সরকারি তথ্য বলছে— ওই তিন মাসে (এপ্রিল থেকে জুন) গত বছরের তুলনায় জাতীয় উৎপাদনে সঙ্কোচন হয়েছে ২৩.৯ শতাংশ। এই তথ্য এখন বাসি। এই তথ্যের মানে কী, তা নিয়েও কম আকচাআকচা চলেনি ফেসবুক থেকে শুরু করে হোয়াটসঅ্যাপে। আর এই সব আলোচনা থেকে আমরা অনেকেই মনে করতে শুরু করেছি— অতিমারিই বোধহয় আমাদের সর্বনাশের মূল এবং একমাত্র কারণ। কলকারখানা খোলা থাকলেই আমাদের ঘরে লক্ষ্মী থাকতেন অচঞ্চলা! কিন্তু তাই কি?
অতিমারির কারণে কলকারখানা বন্ধ থেকেছে। গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই টলে গিয়েছে। ফলে কে অস্বীকার করবে যে কোভিডের বিষ বিশ্ব অর্থনীতির শিরায় শিরায় ছড়িয়েছে? কিন্তু যদি অতিমারি না হত, তা হলে কি আমাদের অবস্থা ভাল হত? মনে হয় না। কারণ গত বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে কিন্তু বৃদ্ধির হার পড়েছিল পাঁচ শতাংশ। গত বছর অতিমারি ছিল না। কিন্তু অর্থনীতির অধঃগতি ছিল অব্যাহত। এবং গত বছরের এই পতনের হারও কিন্তু বিগত বেশ কয়েক বছরের ইতিহাসে যে কোনও খারাপ সময়কেও ছাপিয়ে গিয়েছে। আর কারণ কিন্তু একটাই। দেশে চাহিদাকে কিছুতেই চাগাড় দিয়ে তোলা যাচ্ছিল না। দেশের বাজারে এমন কিছু মৌলিক পরিবর্তন হয়নি, যা থেকে মনে করা যেতে পারে যে অতিমারি না হলে এই পতন হয়ত রুখে যেত। কারণ, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের হিসাব বলছে— দেশে আর্থিক বৃদ্ধির পতন অব্যাহত থেকেছে পর পর ছয়টি ত্রৈমাসিক ধরে। এটা বিগত প্রায় সিকি শতকের রেকর্ড।
আরও পড়ুন: ‘অরুণাচলকে স্বীকৃতিই দেয়নি চিন’, সঙ্ঘাত উস্কে ফের মন্তব্য বেজিংয়ের
আরও কয়েকটি তথ্যে চোখ রেখে ফিরব মাংসওয়ালার তথা গোটা বাজারের চ্যালেঞ্জ এবং সরকারি নীতিনির্ধারদের সিদ্ধান্তের দোলাচলের প্রসঙ্গে। উপদেষ্টা সংস্থা পিডব্লিউসি সম্প্রতি কোভিডের ছোবলে বাজারে ক্ষতি এবং কী করা যেতে পারে তা নিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা করেছে। বহু তথ্য একজোট করে এই সমীক্ষাটি ঘুরে দাঁড়ানোর একটা দিশা খোঁজার চেষ্টা করেছে। তাতে যে সব তথ্যের উপর আলো ফেলা হয়েছে তার মধ্যে একটি হল কোভিডের আগে দেশের হাল কেমন ছিল। এবং তা আমাদের আলোচনার সুরেই বলছে— বেশ খারাপই ছিল। যেমন ২০১৮-১৯ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে উৎপাদন ক্ষমতার ৭৬ শতাংশ ব্যবহারে ছিল। ২০১৯-২০ সালের সেই তৃতীয় ত্রৈমাসিকে তা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৬৯ শতাংশে। সহজ বাংলায় তার মানে দাঁড়ায় একটাই। বাজারে চাহিদা নেই, তাই উৎপাদন কমছে।
মাথায় রাখতে হবে আমাদের দেশের আর্থিক বৃদ্ধির মূলে রয়েছে কিন্তু ঘরোয়া চাহিদা। জাতীয় উৎপাদনের ৭০ শতাংশই কিন্তু নির্ভর করে ঘরোয়া চাহিদার উপর। কলকারখানা তৈরির চাহিদাও কিন্তু এর অংশ। কিন্তু দেশের বাজারে অনাস্থার কারণেই বিনিয়োগের চাহিদা কমছে। অতিমারির আগে থেকেই। এর প্রতিফলন আমরা দেখেছি বৃদ্ধির হারের অধঃপতনে। অতিমারি তাতে আরও ইন্ধন দিয়েছে। এতটাই যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও স্বীকার করেছে যে— আগামী দিনে যদি চাহিদাকে চাগাড় না দেওয়া যায় তা হলে কিন্তু দেশের আর্থিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ের জায়গা আছে।
কিন্তু নীতি নির্ধারকদের চিন্তায় কি এটা আছে? তাঁদের উচ্চারণ ও সিদ্ধান্তের মধ্যে যে ফারাক, তা কিন্তু আরও অনাস্থার জায়গা তৈরি করে দিচ্ছে। শীর্ষব্যাঙ্ক ঋণের উপর সুদের হার কমিয়েছে যাতে বিনিয়োগের খরচ কমে। এই আশায় যে এর ফলে বিনিয়োগে গতি আসবে। আজ প্রকৃত সুদের হার (সুদের হার - মূল্যবৃদ্ধির হার = প্রকৃত সুদের হার) শূন্যের তলায়। কিন্তু বিনিয়োগ বাড়ার কোনও চিহ্ন নেই।
আরও পড়ুন: হাইপারসনিক যুগের সূচনা, দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি যানের সফল পরীক্ষা
আমরা জানি বিগত কয়েক বছর ধরেই বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। কারণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার সঙ্কুচিত হচ্ছে। তাই সাধারণের পকেটেও টান। অথচ সবাই বলছে চাহিদা বাড়াতে সরকারকেই পদক্ষেপ করতে হবে। বাজারের যখন এই অবস্থা, তখন কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিতে স্বেচ্ছাবসর চালু করতে চলেছে। অদক্ষতার সমস্যাটা মানি। এটাও মানি যে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিতে কাজের তুলনায় লোক বেশি। কিন্তু এই বাজারে অর্থনীতিবিদরা যখন বলছেন চাহিদা বাড়াতে লোকের হাতে টাকা তুলে দিতে, তখন এই কর্মসঙ্কোচন কিন্তু বাজারের চাহিদার উপর আরও বড় আঘাত করবে।
সমস্যাটা এখানেই। একদিকে সুদ কমানো হচ্ছে যাতে বিনিয়োগের খরচ কমে, নাগরিককে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে কম সুদে ঋণ করে ফ্ল্যাট কিনতে, আবার একই সঙ্গে তাঁদের চাকরি বলিতে চড়ানো হচ্ছে। চাহিদা ও জোগানের যে দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে, তাকে না ভেঙে সরকারি এই নীতি কিন্তু তাতে আরও ইন্ধনই জুগিয়ে চলেছে। কল্যাণীর ওই মাংসওয়ালার মতো আমরাও কিন্তু কোভিডের সঙ্গে নীতি দোলাচলের চাপে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি না। এই দোলাচল থাকলে নিকট ভবিষ্যতে আদৌ শ্বাস নেওয়ার অবকাশ মিলবে কি? না কি, সাধারণ কথা ধার করেই বলি, আমাদের ঘটিবাটি বিক্রি করেই পেটের সংস্থান করতে হবে?