আমেরিকার নাসা-সহ বিশ্বের বাকি উন্নত দেশগুলির মহাকাশ গবেষণা সংস্থাকে টেক্কা দিয়েছে ইসরো। বীরবিক্রমে রোভার ‘প্রজ্ঞান’কে নিয়ে চাঁদের উদ্দেশে সফল পাড়ি দিয়েছে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’। এই ‘জায়ান্ট লিপ’-এর মধ্যে দিয়ে ইসরো শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করল তার মানসপিতা, বিক্রম সারাভাইকে। তাঁর নামেই ল্যান্ডারের নামকরণ করা হয়।
ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার এই স্বর্ণাভ বর্তমানের নেপথ্যে জড়িয়ে আছে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের রহস্যময় অতীত। তিনি বিক্রম সারাভাই। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ। জাতীয় স্তরে গঠনমূলক বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। অথচ, তাঁর মৃত্যুর উপর থেকে রহস্যের যবনিকা আজও সরল না।
১৯১৯ সালের ১২ অগস্ট তাঁর জন্ম গুজরাতের বিখ্যাত সারাভাই পরিবারে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী পরিবারের অবদান অনেক। যদিও বিক্রমের আকর্ষণ ছিল বহুমুখী। বিজ্ঞান থেকে ক্রীড়া হয়ে সংখ্যাতত্ত্ব। তবে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তনীর আকর্ষণের ভরকেন্দ্র ছিল অবশ্যই বিজ্ঞান। তিনি আজীবন চেয়ে এসেছিলেন পারমাণবিক শক্তি ব্যবহৃত হোক মানবকল্যাণে।
ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত ‘ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিক্রম। এই সংস্থা-ই ইসরোর পূর্বসূরি। পাশাপাশি আরও বহু সংস্থার জন্মলগ্ন থেকে জড়িয়ে আছে বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের নাম। নেহরু ফাউন্ডেশন ফর ডেভলপমেন্ট, আইআইএম ( আমদাবাদ), ভ্যারিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রোন প্রজেক্ট, ইলেকট্রনিক কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড-সহ আরও বহু সংস্থার প্রাণপুরুষ ছিলেন সারাভাই।
১৯৭৫ সালে রুশ কসমোড্রোম থেকে সফল উৎক্ষেপণ হয় ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘আর্যভট্ট’-র। এই সাফল্যে যাঁর অবদান অগ্রগণ্য, সেই বিক্রম সারাভাই কিন্তু এই সুদিন দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে মৃত্যু হয় এই বিজ্ঞানসাধকের। বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেরই অভিমত, তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না।
১৯৭১-এর ডিসেম্বের কেরলের কোভালামে গিয়েছিলেন বিক্রম সারাভাই। সেখানে একটি রুশ রকেটের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করেন । থুম্বা রেলস্টেশনের উদ্বোধনও হয়েছিল তাঁর হাতে। কোনও সময়েই তাঁর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি। কোভালমে প্রায়ই যেতেন তিনি। থাকতেন নিজের পছন্দের সরকারি অতিথিশালায়। সেই অতিথিশালার একটি ঘরে ৩১ ডিসেম্বর সকালে পাওয়া গিয়েছিল বিক্রম সারাভাইয়ের নিথর দেহ।
তাঁর দেহে কোনও আঘাতের চিহ্ন ছিল না। তবে মৃত্যুর কারণ কী? জানার জন্য হয়নি ময়না তদন্ত বা অটোপ্সি। রহস্য উদঘাটনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়নি কোনও তদন্তেরও। অথচ তিনি এতই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন বিমানে তাঁর পাশের আসন ফাঁকা রাখা হত। ট্রেন সফর করলে বুক করা হত গোটা একটা কুপ। কিন্তু তাঁর মৃত্যু ঘিরে আছে শীতল উদাসীনতা।
তাঁর পরিবারের তরফেও কোনও তদন্ত দাবি করা হয়নি। বিক্রম ও মৃণালিণী সারাভাইয়ের দুই সন্তান, কন্যা মল্লিকা ও পুত্র কার্তিকেয়। পরবর্তীকালে কার্তিকেয় জানিয়েছিলেন, তাঁদের ঠাকুমা সরলাদেবীই চাননি ছেলের মৃতদেহ কাঁটাছেড়া করা হোক।
বিক্রমপুত্র কার্তিকেয় নিজে কেম্ব্রিজে বসে বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন । শুটিং উপলক্ষে মল্লিকা ছিলেন তৎকালীন বম্বেতে। বিশ্বের দু’ প্রান্তে বসে তাঁরা শুনেছিলেন বিজ্ঞানতপস্বী বাবার হঠাৎ চলে যাওয়া। অথচ তাঁরা জানতেন নিউ ইয়ার্স ইভ পালন করতে বাবা ফিরে আসবেন আমদাবাদ।
অমৃতা শাহ-এর লেখা বিক্রমের জীবনী ‘বিক্রম সারাভাই—এ লাইফ’-এ কিন্তু বিজ্ঞানীর মৃত্যুতে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত আছে। আইআইএম আমদাবাদ সূত্রে বিক্রম-ঘনিষ্ঠ কমলা চৌধুরী সেখানে বলেছেন, বিক্রম তাঁকে বলতেন রাশিয়া ও আমেরিকা, দু’টি দেশই তাঁর উপর নজর রাখছে।
সারাভাইয়ের আগে আরও এক যশস্বী ভারতীয় বিজ্ঞানীর রহস্যমৃত্যু আলোড়ন ফেলেছিল। ভারতের পারমাণবিক গবেষণার জনক ডক্টর হোমি জাহাঙ্গির ভাবার মৃত্যু হয়েছিল বিমান দুর্ঘটনায়। ১৯৬৬ সালের ২৪ জানুয়ারি আল্পসের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মঁ ব্লাঁ-র কাছে আছড়ে পড়েছিল এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ১০১। প্রাণ হারান ডক্টর ভাবা। তাঁর সঙ্গেই চিরকালের জন্য হারিয়ে যায় পারমাণবিক গবেষণার বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি। একে ‘অন্তর্ঘাত’ বলেছে অনেক মহলই।
হোমি ভাবার মৃত্যুর তেরো দিন আগে তাসখন্দে প্রয়াত হয়েছিলেন ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। তিনি গিয়েছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করতে। খাতায় কলমে বলা হয়েছে মৃত্যু হয়েছিল হৃদরোগে। কিন্তু সে তথ্য বিশ্বাসই করতে চাননি তাঁর স্ত্রী। বিভিন্ন মহল থেকে উঠেছিল ময়নাতদন্তের দাবি। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। রহস্যের পর্দা উন্মোচিত হয়নি।
চাঁদের কলঙ্কের মতোই দেশের গায়ে লেগে থাকে এই রহস্যের দাগ। চাঁদের মাটিতে পা রাখতে গিয়েছে ল্যান্ডার 'বিক্রম'। অন্তরীক্ষ সাক্ষী হতে চলেছে পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ, শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পদকজয়ী বিক্রম সারাভাইয়ের বহুলালিত স্বপ্নের।