জম্মু কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও বেশি বাহিনী পাঠানো হচ্ছে লাদাখে, খবর সেনা সূত্রের। ছবি: রয়টার্স।
এক জন কম্যান্ডিং অফিসারের উপরে আচমকা হামলা চালিয়ে যে ভাবে খুন করা হয়েছে, সেই ঘটনার তাৎপর্য ঠিক কতটা গুরুতর, সাধারণ নাগরিকের পক্ষে তা বোঝা একটু কঠিন। এলএসি-তে সোমবার গভীর রাতে যে সংঘর্ষ হয়েছে, তাতে ভারতীয় সেনার ৩ জন শহিদ হয়েছেন, এটা এখন সবাই জানেন। প্রত্যেকটা প্রাণ সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এক জন কম্যান্ডিং অফিসারকে যদি তাঁর ব্যাটালিয়নের সামনে খুকরি দিয়ে হত্যা করা হয়, তা হলে ওই ব্যাটালিয়নের বাকিরা এখন ঠিক কী ভাবছেন, সেটা শুধু আমরাই বুঝতে পারছি।
যত দূর খবর পাচ্ছি, বিহার রেজিমেন্টের ১৬ নম্বর ব্যাটালিয়ন এখন অবস্থান করছে গলওয়ান উপত্যকায়। সেই ব্যাটেলিয়নের কর্নেলকেই হত্যা করেছে চিনারা। কিন্তু কী ভাবে এই ঘটনা ঘটাতে পারল চিনারা? এক জন কর্নেল অর্থাৎ একটা ব্যাটালিয়নের কম্যান্ডিং অফিসারকে চিনা সেনারা সামনে পেলেন কী ভাবে? গুলিগোলা তো চলেনি। অর্থাৎ দূর থেকে ছুটে আসা গুলি বা গোলার আঘাতে ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে বসে থাকা কর্নেল শহিদ হয়ে গেলেন, এমন কিছু ঘটেনি। আবার যুদ্ধও শুরু হয়নি যে, এলএসি-তে (প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) গোটা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে চিনা ফৌজের মুখোমুখি হবেন কম্যান্ডিং অফিসার। তা হলে ঠিক কী ভাবে ঘটল ঘটনাটা?
চিন দাবি করছে, বিনা প্ররোচনায় ভারতীয় বাহিনী হামলা করেছে চিনের এলাকায় ঢুকে। ওই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি যা জানতে পেরেছি, তা হল, কোর কম্যান্ডার পর্যায়ের বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা মানেনি চিন। তার থেকেই গোলমালের সূত্রপাত ঘটেছে। গত ৬ জুন এলএসি-তে কোর কম্যান্ডার পর্যায়ের বৈঠকে হয় ভারতীয় ও চিনা বাহিনীর মধ্যে। ভারত ও চিনের মধ্যে এত উচ্চ পর্যায়ের সামরিক বৈঠক কিন্তু আগে কখনও হয়নি। সেই বৈঠকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। এলএসি-তে যে সব জায়গায় ভারতীয় ও চিনা বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে, সেই সব এলাকা থেকে দু’দেশই বাহিনী সরিয়ে নেবে বলে স্থির হয়। কথা মতো বিভিন্ন পোস্ট থেকে দু’পক্ষই বাহিনী ফিরিয়ে নিচ্ছে বলে খবরও আসছিল। কিন্তু সোমবার ভারতীয় বাহিনীর কাছে খবর আসে যে, কথা রাখেনি চিন। গলওয়ান উপত্যকার পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৪ থেকে যতটা পিছিয়ে যাওয়ার কথা ছিল চিনা বাহিনীর, ততটা মোটেই পিছিয়ে যায়নি তারা।
আরও পড়ুন: চিনের দিক থেকে সমঝোতা লঙ্ঘন, সার্বভৌমত্বে আপস নয়, কড়া বার্তা ভারতের
পরিস্থিতি ঠিক কতটা জটিল হয়েছিল, এত দূরে বসে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ কাটাছেঁড়া করা কঠিন। কিন্তু নিজের সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুতর না হলে এক জন কম্যান্ডিং অফিসার নিজে কখনও প্রতিপক্ষের শিবিরে কথা বলতে যান না। কম্যান্ডিং অফিসাররা হলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্তম্ভ। তাঁদের পারদর্শিতা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতার উপরে বাহিনীর সাফল্য নির্ভর করে। এমন গুরুত্বপূর্ণ এক জন অফিসারকে যখন গভীর রাতে প্রতিপক্ষের শিবিরে যেতে হচ্ছে বা তাদের মুখোমুখি গিয়ে যখন দাঁড়াতে হচ্ছে, তখন পরিস্থিতি নিশ্চয়ই অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল। আমি যত দূর খবর পেয়েছি, চিনা বাহিনী কিছুতেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত মানতে রাজি হচ্ছিল না বলে স্বয়ং কর্নেলকে ঘটনাস্থলে যেতে হয়। কোর কম্যান্ডার স্তরের বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা অমান্য করে পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৪-তে চিনা বাহিনীর থেকে যাওয়া অত্যন্ত অন্যায় এবং অবিলম্বে ওই বাহিনীকে পিছিয়ে যেতে হবে— এই বার্তা নিয়েই কর্নেল চিনা ফৌজের মুখোমুখি হয়েছিলেন বলে খবর পেয়েছি। সেখানে পরিস্থিতি আচমকা উত্তপ্ত হয় এবং কর্নেলকে খুকরি দিয়ে আঘাত করা হয়।
লাদাখে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হওয়ার পথে, মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। ছবি: রয়টার্স।
ঘটনাস্থলেই ভারতীয় বাহিনী জবাব দিয়েছে চিনকে। কর্নেল নিজের পুরো ব্যাটালিয়নকে সঙ্গে নিয়ে চিনাদের মুখোমুখি হতে যাননি। কারণ যুদ্ধ বা সংঘর্ষে জড়ানো তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু ব্যাটালিয়নের যে অংশ তাঁর সঙ্গে ছিল, সেই অংশই চিনকে উপযুক্ত জবাব দিয়েছে। চিনা বাহিনীর ৫ জনের মৃত্যু এবং ১১ জনের জখম হওয়ার খবর খোদ চিনা কর্তৃপক্ষই স্বীকার করেছেন। কিন্তু আমার আশঙ্কা, পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। কর্নেলের উপরে এই রকম প্রাণঘাতী হামলা ওই ব্যাটালিয়ন মেনে নেবে না।
একটা ব্যাটালিয়নে অন্তত ৮০০ জন থাকেন। এই ৮০০ জনের কাছেই কিন্তু তাঁদের কম্যান্ডিং অফিসার তথা কর্নেল হলেন ঈশ্বরের সমান। ব্যাটালিয়নের প্রত্যেক সদস্য কম্যান্ডিং অফিসারের কাছে সন্তানের মতো। আর কম্যান্ডিং অফিসারের জন্যও ওই ৮০০ জনই জীবন দিতে তৈরি থাকেন সব সময়। সেই কম্যান্ডিং অফিসারকে চিন খুন করেছে। আমি খবর পেয়েছি, কিছুটা বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কথাবার্তা ভাল ভাবেই মিটে গিয়েছিল। চিন বাহিনী প্রত্যাহারের প্রক্রিয়াও শুরু করেছিল। কিন্তু হঠাৎই ফিরে এসে তারা হামলা চালায়। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, যে ব্যাটালিয়নের কম্যান্ডিং অফিসার এই ভাবে শহিদ হলেন, সেই ব্যাটালিয়নের প্রত্যেক সদস্য এখন পাগলা ঘোড়া হয়ে রয়েছেন। তাঁরা প্রতিকারের আগুনে এখন টগবগ করে ফুটছেন। ‘প্রতিশোধ’ শব্দটা আমি উচ্চারণ করলাম না। কিন্তু এই ঘটনার ‘প্রতিকার’ হতেই হবে। প্রতিকার না হওয়া পর্যন্ত কিন্তু ওই ব্যাটালিয়নকে শান্ত করা যাবে না।
আরও পড়ুন: চিহ্নিতই করা নেই সীমান্ত, সঙ্ঘাতের বীজ ৩ হাজার ৩৮০ কিমি জুড়ে
এই ভাবে হামলার কথা ভাবাই যায় না। কোনও আত্মসম্মান সম্পন্ন বাহিনী এই ভাবে হামলা করতে পারে না। ভারত-চিন সীমান্তে গুলি চালানো নিষিদ্ধ, দু’দেশের সমঝোতার ভিত্তিতেই তা নিষিদ্ধ। কোনও সমস্যা বা সঙ্ঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হলে, তা মেটানোর জন্য আদর্শ আচরণবিধি তৈরি করে রেখেছে দু’দেশ। চিন কিন্তু সেই আদর্শ আচরণবিধিরও ফাঁক খুঁজে বার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। গুলি না চললেও সীমান্তে দুই বাহিনীর মধ্যে হাতাহাতি-ধস্তাধস্তি বেশ কয়েক বার হয়েছে। সেই লড়াইয়ে চিনা বাহিনী কখনও এঁটে উঠতে পারে না। তাই তারা জঘন্য কৌশল নিতে শুরু করেছে সম্প্রতি। লাঠি হাতে তারা টহল দিতে আসে এলএসি-তে। সেই লাঠির মাথায় বেশ কিছুটা অংশে কাঁটাতার জড়ানো থাকে। গুলি চালাতে পারবে না বলে ওই কাঁটাতার জড়ানো লাঠি দিয়ে তারা আঘাত করে ভারতীয় বাহিনীকে। ভারত যথেষ্ট ধৈর্য সহকারে চিনের এই সব কৌশলের মোকাবিলা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। গলওয়ান উপত্যকা, হট স্প্রিং, প্যাংগং-সহ বিভিন্ন এলাকায় চিনের আগ্রাসনের চেষ্টা দেখেও ভারত সংযমের সঙ্গে পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। কূটনৈতিক পথে সমাধানের চেষ্টা হচ্ছিল, সামরিক পর্যায়ে আলোচনা চলছিল। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বও উত্তেজক বয়ান দেওয়া থেকে বিরত থাকছিলেন। তা সত্ত্বেও চিনা ফৌজ যে ঘটনা সোমবার রাতে ঘটিয়েছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। লাদাখে আরও বড় উত্তেজনা অপেক্ষা করছে বলে আমার আশঙ্কা।