ঠেলায় পড়লে কী না হয়!
অনন্ত চাপের মুখে অবশেষে বিরোধীদের দাবি উড়িয়ে দেওয়ার ‘ব্যাকরণ বই’ তাকে তুলে দিতে বাধ্য হল বিজেপি! ব্যপম কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের দাবি আজ মেনে নিলেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান।
অথচ গত কালও ভোপালে তাঁকে সমর্থন জানিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেছিলেন, ‘‘তদন্তটি উচ্চ আদালতের বিচারাধীন। আদালত চাইলে তবেই সিবিআই তদন্ত হতে পারে। না হলে সম্ভব নয়।’’
এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ডিগবাজি খেলেন খোদ শিবরাজ! আদালত কিছু বলার আগেই জানিয়ে দিলেন, তিনি উচ্চ আদালতের কাছে সিবিআই তদন্তের জন্যই আর্জি জানাবেন!
কেন এই ভোলবদল? রাজনীতিকরা মনে করছেন, নেপথ্যে দু’টি কারণ থাকতে পারে। এক, ব্যপম-কাণ্ডে মরণযাত্রা অব্যাহতই। গতকাল ভোরে এক মহিলা সাব-ইনস্পেক্টরের লাশ মিলেছিল ঝিলের জলে। পরে এই কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত এক পুলিশ কনস্টেবলের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় টিকমগড়ের এক অতিথিশালা থেকে। তাতে বিরোধীদের চাপ আরও বাড়ে। দুই, ব্যপম-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত চেয়ে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিংহ যে মামলা করেছিলেন, আজ সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, তারা আগামী পরশু তা শুনবে। ইউপিএ জমানায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় বিরূপ জনমত আলো দেখেছিল সুপ্রিম কোর্টে, উপযুক্ত তদন্তের নির্দেশে। অনেকেই মনে করছেন, ব্যপমের বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ আদালত তেমনই কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে আঁচ করে নিজেই আগেভাগে সিবিআই তদন্তের কথা ঘোষণা করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ, ব্যপম যে তাঁর ঘুম কেড়েছে, আজ নিজেই তা স্বীকার করে নিয়েছেন শিবরাজ! একটি টিভি চ্যানেলে তাঁর মন্তব্য, ‘‘এই সব নিয়ে ভাবনায় গত কাল সারা রাত ঘুমোতে পারিনি!’’ পাশাপাশি, নিজের ভাবমূর্তির বিষয়টাও মাথায় রেখেছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘টাস্ক ফোর্স যে তদন্ত করছে, তা সন্তোষজনক। কিন্তু মানুষের ভাবাবেগের কথা বুঝেই উচ্চ আদালতে আবেদন করতে চলেছি।’’
কিন্তু, মানুষের ভাবাবেগ বা ঘুম উড়ে যাওয়া— কোনও কথাতেই চিঁড়ে ভিজছে না বিরোধীদের। মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে শিবরাজের অপসারণ চেয়ে এখনও অনড় তারা। বস্তুত, গত এক মাস ধরে জাতীয় ও রাজ্য স্তরে বিজেপির একাধিক নেতার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ উঠলেও এই প্রথম ঢোঁক গিলল কেন্দ্রের শাসক দল। উল্টো দিক থেকে দেখলে এটা কংগ্রেস তথা বিরোধীদের প্রথম বড় সাফল্যও বটে। তাই তারা নতুন করে অস্ত্রে শান দিতে শুরু করেছে। এমনিতেই রাজনীতিতে শাসক দল একটু ছাড়লে বিরোধীরা তিন গুণ দাবি করে। সেটাই দস্তুর। যেমন স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে টেলিকম মন্ত্রক থেকে এ রাজার ইস্তফার পর বিজেপি সঙ্গে সঙ্গে যৌথ সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবিতে সংসদ অচল করেছিল। কংগ্রেস এখন সেই পথই নিয়েছে। এ দিন কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ বলেন, ‘‘শিবরাজের শুভবুদ্ধি জেগেছে, ভাল কথা। কিন্তু হাইকোর্ট নয়, সুপ্রিম কোর্টে চিঠি লিখে সিবিআই তদন্ত দাবি করুক মধ্যপ্রদেশ সরকার। সেই তদন্ত সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে হোক। স্পেকট্রাম তদন্তের মতো প্রতি সপ্তাহে তদন্তের অগ্রগতি খতিয়ে দেখুক তারা।’’
আর রাজ্যের কংগ্রেস নেতা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া বলেন, ‘‘শিবরাজ সিংহের ব্যক্তিগত সচিব থেকে শুরু করে রাজ্যস্তরে তাঁর ঘনিষ্ঠ একাধিক বিজেপি ও সঙ্ঘ নেতা ব্যপম কেলেঙ্কারিতে জড়িত। তাই শিবরাজের ভূমিকারও তদন্ত করতে হবে। এবং তা নিরপেক্ষ তখনই হবে, যখন শিবরাজ মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকবেন না।’’ শিবরাজকে সরাতে কৌশলে বিজেপির অন্দরের কোন্দলও ব্যবহার করতে চাইছে কংগ্রেস। একই সঙ্গে এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও বিঁধতে ছাড়েননি জ্যোতিরাদিত্য। উমা ভারতী বা স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স প্রধান যে প্রাণহানির আশঙ্কার কথা বলেছেন, সেই প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘‘দেশের এত বড় সমস্যা নিয়ে মুখ খোলার বদলে প্রধানমন্ত্রী কাজাখস্তানে বসে টুইট করছেন!’’
সার্বিক এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা তাৎপর্যপূর্ণ। তবে কংগ্রেসের শীর্ষ সূত্র জানাচ্ছে, শুধু সর্বোচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে না কংগ্রেস। দলের নেতাদের বক্তব্য, অনেক দিন পর বিজেপি-কে বাগে পাওয়া গিয়েছে। কেবল ব্যপম-কাণ্ড তো নয়, ললিত মোদী-কাণ্ডে সুষমা-বসুন্ধরা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছেন। মহারাষ্ট্রে দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। ছত্তীসগঢ়েও ছত্রিশ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের বিরুদ্ধে। সংসদে এঁদের সবার ইস্তফা চেয়ে গোল বাধাতে এখন থেকেই দম নিতে শুরু করেছে কংগ্রেস। পাশাপাশি, বিজেপি শাসিত এই রাজ্যগুলিতে এ বার সফর শুরু করতে চলেছেন রাহুল গাঁধীও। প্রাথমিক লক্ষ্য হল, সংসদের বাদল অধিবেশনের আগে বিজেপি-বিরোধী আবহ তৈরি। কিন্তু তাঁর বৃহত্তর লক্ষ্য, বিজেপির দুর্নীতি নিয়ে জনমানসে বিরূপ ভাবমূর্তি তৈরি করে মোদীর প্রশাসনিক স্বচ্ছতার দাবি খারিজ করা। জমি আইন সংশোধনের বিরোধিতা করার সময় ঠিক যে ভাবে ‘স্যুট-বুটের সরকার’ বলে মোদীকে বিঁধেছিলেন তিনি, এ বার তারই দ্বিতীয় সংস্করণ বাজারে ছাড়তে চান রাহুল।
মজার ব্যাপার হল, কংগ্রেস যখন এ ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন বিপদকালে বুদ্ধিনাশের দশা যেন গ্রাস করছে বিজেপিকে! ব্যপম-কাণ্ডের স্পর্শকাতরতার কথাটি বেমালুম ভুলে গিয়ে গত কাল বেফাঁস মন্তব্য করেছিলেন বিজেপির মধ্যপ্রদেশের নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়। তিনি আবার সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সংগঠন করার দায়িত্ব পেয়েছেন। কৈলাসকে নিয়ে অস্বস্তি কাটার আগেই আজ কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়া একটি বিতর্কিত মন্তব্য করেন। ব্যপম-সহ বিবিধ দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিরোধীরা যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিবৃতি দাবি করছেন, তখন গৌড়ার মন্তব্য, ‘‘সব তুচ্ছ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের মন্ত্রীরা বা বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর মন্তব্যই যথেষ্ট।’’ এ নিয়ে শোরগোল পড়তেই সময় নষ্ট না করে বিজেপির তরফে বলা হয়, উনি ললিত মোদী প্রসঙ্গে এই মন্তব্য করেছেন। কিন্তু দুর্দিনে এ সব ব্যাখ্যা কেই বা শুনেছে!
তবে রাজনীতির এই সাত-সতেরোর ঊর্ধ্বে ব্যপম তদন্তের ভবিষ্যৎ নিয়ে মৌলিক প্রশ্নটা রয়েই গেল। শেষ পর্যন্ত সিবিআই তদন্ত হবে কি? সবটাই এখন আদালতের নির্দেশের ওপর নির্ভর করছে। মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট।