সারা জীবনের সঞ্চিত টাকার একটা বড় অংশ দিয়ে ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট (এনএসসি) কিনেছিলেন ঢাকুরিয়ার বিমল মুখোপাধ্যায়। ছ’বছরের মেয়াদ শেষে গত ১৯ মে টাকা তুলবেন ভেবে বেশ আনন্দেই ছিলেন তিনি। কিন্তু কোথায় কী! দিনের পর দিন কসবা পোস্ট অফিসে চক্কর কেটেও টাকা না পেয়ে এক অজানা আশঙ্কায় শরীরের অবনতি ঘটেছে বৃদ্ধের।
প্রায় একই হাল হয়েছে রাজ্যের অবসরপ্রাপ্ত ফরেন্সিক ডিরেক্টর হরিদাস মৈত্রর। তিনি মানি অর্ডার পাঠাতে পারছেন না, হকের টাকাও তুলতে পারছেন না। ক্ষুব্ধ ও হতাশ হরিদাসবাবুর কথায়, ‘‘সারা জীবনের সঞ্চয় কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার কাছে জমা রেখেও শেষ বয়সে এমন হয়রানির শিকার হতে হবে ভাবিনি।’’ একই সুর বিমলবাবুর জামাই বিপ্লব ভট্টাচার্যের গলাতেও, ‘‘এনএসসি-র টাকা তোলার জন্য কখনও আমার স্ত্রী, কখনও আমি অপেক্ষা করছি। সারাদিন লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পরে শেষে জানতে পারছি টেকনিক্যাল ফল্টের জন্য টাকা পাব না। কবে পাব, তা-ও বলতে পারছেন না ডাকঘরের কর্মীরা।’’
কসবা থেকে ঘাটাল, খড়্গপুর থেকে ভবানীপুর— সর্বত্র হয়রানির ছবিটা কমবেশি একই রকম। ডাকঘরের কর্মীরা জানাচ্ছেন, সমস্যার সূত্রপাত গত বছর থেকে। ধীরে ধীরে সেটা বাড়তে থাকে। আর গত মার্চ থেকে তা চরম আকার নিয়েছে।
কী রকম?
আমানতকারীদের অভিযোগ, জমানো টাকা তুলতে গিয়ে চরম হয়রান হতে হচ্ছে, সময় পেরিয়ে গেলেও টাকা ফেরত পেতে মাসের পর মাস গড়িয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এমন যে আর্থিক বছরের শেষ মাস মার্চে বেশি সুদের সুবিধা পেতে ডাকঘরের বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা জমা রাখতে চেয়েও বিফল হতে হয়েছে বহু মানুষকে। সব চেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন অবসরপ্রাপ্তরা। অবসরের টাকা তুলতে না পেরে সংসারে আর্থিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে তাঁদের। গত কয়েক মাস ধরে এই অবস্থা চলছে রাজ্য জুড়ে।
হেনস্থার এই কাহিনির জন্য যাঁদের দিকে আঙুল তুলেছেন আমানতকারীরা, সেই ডাকঘর কর্তৃপক্ষের অবস্থা এখন অনেকটা নিধিরাম সর্দারের মতো। এই দূরবস্থার জন্য আমানতকারীদের আপ্তবাক্য শোনানো ছাড়া যেন কিছুই করার নেই। ডাক বিভাগের এক অধিকর্তা বলেন, ‘‘লিঙ্কের সমস্যার জন্য কাজের গতি এতটাই কমেছে যে গত আর্থিক বছরের (৩১ মার্চ) কাজ শেষ হয়েছে ২০ এপ্রিল।’’ তাঁর অসহায় মন্তব্য, ‘‘সফটওয়্যারের সমস্যা হলে আমাদের সংশ্লিষ্ট জায়গায় ই-মেল করা ছাড়া কিছু করার নেই।’’
তবে ডাকঘরের পশ্চিমবঙ্গ সার্কেলের চিফ পোস্টমাস্টার জেনারেল অরুন্ধতী ঘোষের দাবি, ‘‘২০১২ সালে সিবিএস বা কোর ব্যাঙ্কিং সলিউশন প্রকল্প চালু হওয়ার পর গত কয়েক বছরে রাজ্যে আমানতকারী ও ডাকঘরের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তাই সফটওয়্যারে বেশি চাপ (লোড) পড়ায় সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি, ইন্টারনেট লিঙ্ক বিকলের কারণেও সমস্যা হচ্ছে। তবে তা দ্রুত সমাধানের চেষ্টাও হচ্ছে।’’ প্রশ্ন ছিল, বছর গড়ালে ডাকঘর ও আমানতকারীর সংখ্যা বাড়বে এবং সেই কারণে সফটওয়্যারের উপর বেশি চাপ পড়বে— এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা আগাম আঁচ করে কেন সেইমতো পরিকল্পনা করা হয়নি? সরাসরি এর উত্তর না দিয়ে অরুন্ধতীদেবীর আশ্বাস, ‘‘সমস্যা আগের চেয়ে অনেকটাই কমেছে। আশা করছি, মাসখানেকের মধ্যে সমস্যা মিটে যাবে।’’
ডাকঘর সূত্রের খবর, গ্রাহকদের উন্নত পরিষেবা দিতে দেশের সমস্ত ডাকঘরকে এক সূত্রে বাঁধার জন্য কোর ব্যাঙ্কিং সলিউশন (সিবিএস) ব্যবস্থা চালু ডাক বিভাগ। এই ব্যবস্থায় এক ডাকঘর থেকে অন্য ডাকঘরে অতি দ্রুত টাকা লেনদেন করা যাবে। কিন্তু উন্নত পরিষেবা দিতে গিয়ে সিবিএস নিজেই আক্রান্ত নানা রোগে, মাসের পর মাস যার শিকার হচ্ছেন বিমল মুখোপাধ্যায়, হরিদাস মৈত্রের মতো কয়েক লক্ষ আমানতকারী।
কী ভাবে?
রাজ্যের বিভিন্ন ডাকঘরে যে কোন কাজ নিয়ে গেলেই কর্মীরা বাধা বুলির মতো দু’টি কথা বলে যাচ্ছেন— ‘লিঙ্ক ফেলিওর’, ‘টেকনিকাল ফল্ট’। আর এতেই আটকে যাচ্ছে এনএসসি, কিষাণ বিকাশপত্র, রেকারিং ডিপোজিট, মাসিক আয় প্রকল্পের মতো আরও অনেক কাজে টাকা জমা ও তোলার কাজ। কোথাও ঝড়-জল-রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর হয়তো মিলছে মুক্তি। অনেক ডাকঘর আবার দিনের পর দিন সময় দিয়েও ফিরিয়ে দিচ্ছে আমানতকারীকে। ডাকঘরের বিভিন্ন প্রকল্পের এজেন্টদের মতে, ‘‘সব চেয়ে খারাপ অবস্থা অবসরপ্রাপ্তদের। অনেকেই অবসরের পরে পুরো টাকা ডাকঘরে রেখেছেন। নির্দিষ্ট দিনে, বা তার পরেও টাকা না-পেয়ে তাঁদের নিদারুণ অবস্থা।’’ পার্কস্ট্রিট ডাকঘরের এমনই এক জন এজেন্ট গৌরব সাহা বলেন, ‘‘সময় মতো টাকা তুলে দিতে না পারায় আমানতকারীদের কাছ থেকে নানা কথা শুনতে হচ্ছে। ডাকঘরও ঠিক করে কিছু বলতে পারছে না। সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা।’’
সমস্যার এটা যদি একটা দিক হয়, অন্য দিকে তবে চরম পরিকাঠামোগত অভাবও পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। ডাকঘর সূত্রেই খবর, বহু জায়গাতেই কর্মীর অভাবে ঠিকমতো পরিষেবা দেওয়া যাচ্ছে না। এক দিনের কাজ তিন-চার দিনে করতে হচ্ছে। ধরা যাক, খড়্গপুর উপ-ডাকঘরের কথা। খড়্গপুরের বোগদা এলাকার এই ডাকঘর থেকেই ২৩টি ডাকঘরকে অর্থ দেওয়া হয়। এ ছাড়াও ২০টি শাখা অফিস এই ডাকঘরের অধীন। অথচ এমন ডাকঘরে বসার জায়গা নেই, পানীয় জল নেই, খসে পড়ছে পলেস্তারা। আগে ১৮ জন কর্মীকে নিয়ে ৬টি কাউন্টার চালু থাকত। এখন ৩টি কাউন্টার চলে ১০ জন কর্মী দিয়ে।
পোস্টমাস্টার অভিজিৎ সাঁইয়ের পর্যবেক্ষণ, “এমন অবস্থার মধ্যে কাজ করা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।’’ একই রকম ভাবে উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ মহকুমা থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবারের ডাক-অফিসও কর্মীর অভাবে ধুঁকছে। গ্রাহকদের একাংশের অভিযোগ, কর্মীদের প্রশিক্ষণের অভাবে ভুল তথ্যও পাচ্ছেন তাঁরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালেও ছবিটা সেই এক। সেখানে একটি মাত্র ক্যাশ কাউন্টার থাকায় টাকা জমা-তোলার কাজে বহু সময় লেগে যাচ্ছে।