শিক্ষার্থী-জীবনে রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় পরপর তিন বছর হিন্দিভাষার সেরা বক্তার শিরোপা। ছোট থেকেই বাকপটু। সেই ধারা বজায় ছিল জীবনের শেষ দিন অবধি। মতাদর্শে পার্থক্য থাকলেও বাগ্মী সুষমা স্বরাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তামাম ভারতীয় রাজনৈতিক মহল।
মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও টুইটে প্রধানমন্ত্রীকে কাশ্মীর-প্রসঙ্গে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন, এই দিনটা দেখার জন্য তিনি জীবনভর অপেক্ষা করেছিলেন। তার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই বিশ্ব জানল, প্রয়াত সুষমা স্বরাজ। ৬৭ বছর বয়সে।
জন্ম ১৯৫৩-র ১৪ ফেব্রুয়ারি। হরিয়ানার অম্বালা ক্যান্টনমেন্টে। বাবা হরদেব শর্মা ছিলেন আরএসএস-এর সক্রিয় কর্মী। মা লক্ষ্মীদেবী গৃহবধূ। অম্বালা ক্যান্টনমেন্টের সনাতন ধর্ম কলেজ থেকে স্নাতক। মূল বিষয় সংস্কৃত ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান। এরপর আইন নিয়ে পড়াশোনা পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সাতের দশকে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদে হাতেখড়ি রাজনৈতিক জীবনে। জয়প্রকাশ নারায়ণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সক্রিয় কর্মী ছিলেন সুষমা। জরুরি অবস্থার পরে যোগ দিয়েছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টিতে।
রাজনীতির পাশাপাশিই চলছিল আইনবিদ্যা-চর্চা। ১৯৭৩-এ সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী হিসেবে পথচলা শুরু। সেখানেই পেলেন ভবিষ্যতের জীবনসঙ্গীকে।
সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী, স্বরাজ কৌশল এবং সুষমা শর্মার একসঙ্গে পথ চলা শুরু দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থার মধ্যে। ১৯৭৫-এর ১৩ জুলাই সুষমা বিয়ে করেন স্বরাজকে। তারপর থেকেই নতুন পরিচয়, সুষমা স্বরাজ।
স্বরাজ কৌশল সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী এবং একজন ক্রিমিনাল ল’ ইয়ার। তিনি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ অবধি মিজোরামের রাজ্যপাল ছিলেন। আইনজ্ঞ দম্পতির একমাত্র মেয়ে বাঁশুরীও একজন আইনবিদ। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। সুষমার বোন বন্দনা শর্মা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। ভাই গুলশন শর্মা আয়ুর্বেদ চিকিৎসক।
ভারতীয় রাজনীতির মঞ্চে সুষমা অনেক ক্ষেত্রেই ‘সর্বপ্রথম’। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে বিধায়ক। অম্বালা বিধানসভা কেন্দ্রে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ এবং আবার ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ অবধি তিনি বিধায়ক ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী দেবী লালের জনতা পার্টির সরকারে তিনি মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বিজেপি-লোক দলের জোট সরকারে ১৯৮৭-১৯৯০ সুষমা ছিলেন হরিয়ানার শিক্ষামন্ত্রী।
সুষমা দিল্লির প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৯৮-এর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর অবধি তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৯০ সালে রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন। ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ দিল্লি থেকে জয়ী সাংসদ সুষমা ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ীর ১৩ দিনের সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী।
১৯৯৮-এ আবার সাংসদ দক্ষিণ দিল্লি থেকে। আরও একবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের দায়িত্বে। এই সময় তাঁর উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ, চলচ্চিত্র নির্মাণকে ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে ঘোষণা করা।
১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কর্নাটকের বেল্লারি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সনিয়া গাঁধীর বিরুদ্ধে। প্রচারের জন্য দ্রুত শিখেছিলেন কন্নড় ভাষা। যদিও তিনি ওই নির্বাচনে জয়ী হননি, কিন্তু এই মোড় থেকেই উঠে আসে সনিয়া-সুষমা দ্বন্দ্ব।
সংসদে ফের প্রত্যাবর্তন ২০০০ সালে, উত্তরপ্রদেশ থেকে রাজ্যসভার সদস্য হয়ে। ওই বছরেই ফের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের কার্যভার। ২০০০-এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৩-এর জানুয়ারি পর্যন্ত।
জানুয়ারি ২০০৩ থেকে মে ২০০৪ অবধি সুষমা স্বাস্থ্য, পরিবার কল্যাণ এবং সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর সময়েই দেশ জুড়ে ছ’টি এইমস প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজ্যসভায় তৃতীয় বার আগমন ২০০৬ সালে, মধ্যপ্রদেশ থেকে।
মধ্যপ্রদেশের বিদিশা কেন্দ্র থেকে চার লক্ষ ভোটের ব্যবধানে ২০০৯ সালে জয়ী হন সুষমা। পঞ্চদশ লোকসভায় তিনিই ছিলেন সংসদের বিরোধী দলনেতা। এরপর ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে সরকার। ২০১৯ অবধি টানা পাঁচ বছর বিদেশমন্ত্রী পদে ছিলেন সুষমা। ইন্দিরা গাঁধীর পরে এই পদে সুষমাই দ্বিতীয় মহিলা রাজনীতিক। অসুস্থতার কারণে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। ছবি: টুইটার
বিদেশমন্ত্রী থাকাকালীন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে খুব সহজে আমজনতার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুষমা। বলা হয়, তাঁর দৌলতে টুইটার পরিণত হয়েছিল হেল্পলাইনে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের সমস্যাগ্রস্ত ভারতীয়দের দিকে।
প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে বন্দি হয়ে পড়া থেকে ভিসার কারণে আটকে থাকা চিকিৎসা— সুষমাকে টুইট করেই মুশকিল আসান হয়েছে সাধারণ মানুষের। চিকিৎসার জন্য ভারতে আসতে হবে এমন পাকিস্তানি দুরারোগ্য রোগীর ভিসার ক্ষেত্রেও দরাজহস্ত ছিলেন মানবিক সুষমা। তাঁকে ‘সুপারমম’ বলেছিল মার্কিন সংবাদমাধ্যম।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এসেছে বিতর্কও। ক্রিকেট কেলেঙ্কারিতে পলাতক ললিত মোদীকে পর্তুগালে তাঁর অসুস্থ স্ত্রীর কাছে যাওয়ার অনুমতি পেতে সাহায্য করার অভিযোগ তার মধ্যে অন্যতম। বিরোধীদের দাবি ছিল, তিনি ললিত মোদীকে ট্র্যাভেল ভিসা পেতেও সাহায্য করেছিলেন।
২০১৮ সালে সুষমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়, যখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন ‘শ্রীমদ্ভগবতগীতাকে’ দেশের জাতীয় পুস্তক হিসেবে ঘোষণা করার জন্য।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকে সুষমার দৃঢ় অথচ নমনীয় ব্যক্তিত্ব। চওড়া সিঁথিতে সিঁদুর, কপালে বড় টিপ, পরনে শাড়ি এবং মানসিকতায় সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকা সুষমা ছিলেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন। দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজনীতিক হয়েও যেন পাশের বাড়ির স্নেহময়ী প্রতিবেশী। যিনি সব বেড়াজাল ভেঙে অকুণ্ঠ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আছেন।