গ্রাফিক: নিরুপম পাল।
প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনার পিছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। গগৈয়ের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে যে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের হয়েছিল আদালতে, তা খারিজ করে বৃহস্পতিবার এমনটাই জানাল সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের দাবি, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) এবং কিছু প্রশাসনিক বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গগৈ। তার জন্য তাঁকে ফাঁসানো হয়ে থাকতে পারে।
শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির পদে থাকাকালীন ২০১৯ সালের ১৯ এপ্রিল গগৈয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ প্রথম সামনে আসে। জুনিয়র হিসেবে কাজ করার সময় ২০১৮-র অক্টোবরে গগৈ তাঁর উপর যৌন নির্যাতন চালান বলে অভিযোগ করেন ওই মহিলা। সংবাদমাধ্যমে রিপোর্টটি যে দিন প্রকাশিত হয়, সে দিন আদালতর কাজকর্ম বন্ধ ছিল। কিন্তু রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পরই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলার শুনানি শুরু করে গগৈ, বিচারপতি অরুণ মিশ্র এবং সঞ্জীব খন্নার ডিভিশন বেঞ্চ এবং যাবতীয় অভিযোগ খারিজ করে।
কিন্তু অভিযোগের তির যাঁর দিকে, সেই গগৈ নিজেই নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের শুনানি কী ভাবে করতে পারেন, তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র চলছে বলে সেই সময় আদালতে হলফনামা জমা দেন উৎসব বাইনস নামের এক আইনজীবী। সেই সংক্রান্ত গোপন তথ্যও বন্ধ খামে আদালতে জমা দেন তিনি। এ নিয়ে একটি স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের করার অনুরোধ জানান সলিশিটর জেনারেল তুষার মেহতা। তার পর বিচারপতি অরুণ মিশ্র নেতৃত্বাধীন ৩ বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে মামলাটি ওঠে। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে প্রাক্তন বিচারপতি একে পট্টনায়েককে দায়িত্ব দেয় আদালত।
২০১৯-এর অক্টোবরেই তদন্তের রিপোর্ট আদালতে জমা দেন পট্টনায়েক। তার পর থেকে এত দিন এ নিয়ে কোনও শুনানি হয়নি আদালতে। বৃহস্পতিবার, প্রায় ১ বছর ৯ মাস পর আদালতে মামলার শুনানি শুরু হয়। তাতে তথ্যপ্রমাণের অভিযোগে মামলাটি খারিজ করে দেয় বিচারপতি সঞ্জয় কিসান কউল, এএস বোপান্না এবং ভি রাম সুব্রহ্মণ্যমের ডিভিশন বেঞ্চ। আদালত বলে, ‘‘বিচারপতি পট্টনায়েক মেনেছেন যে প্রাক্তন বিচারপতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু তার পর প্রায় ২ বছর কেটে গিয়েছে। সেই সংক্রান্ত বৈদ্যুতিন তথ্য (ইলেকট্রনিক ডেটা) এবং প্রমাণ এখন আর উদ্ধার করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া আদালতের অভ্যন্তরীণ কমিটি আগেই গগৈকে ক্লিনচিট দিয়ে দিয়েছে। তাই স্বতঃপ্রণোদিত এই মামলা চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন। এখনই তা খারিজ করা হল।’’
ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টরের রিপোর্টের উল্লেখ করে আদালত জানায়, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি-সহ কিছু প্রশাসনিক বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গগৈ। তার জন্য তাঁকে ফাঁসানো হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু গগৈয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে নয়, বরং বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে কি না, তা খতিয়ে দেখতেই যে বছর দুয়েক আগে ওই কমিটি গঠন করা হয়েছিল, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যে তা স্পষ্ট।
এ নিয়ে বৃহস্পতিবার আদালতকে একহাত নেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। ব্যঙ্গের সুরে টুইটারে তিনি লেখেন, ‘প্রধান বিচারপতি গগৈয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে নয়, বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে কি না, তা দেখতেই কমিটি গড়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ঠিকই মহামান্য আদালত, যৌন হেনস্থার শিকার হওয়া সকলে মিলেই এই ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছেন’।
প্রধান বিচারপতির পদে থাকাকালীন তাঁর নেওয়া একাধিক রায় এবং অবসরের পর বিজেপি-র হয়ে রাজ্যসভায় প্রবেশ— গগৈকে ঘিরে একাধিক বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে সাম্প্রতিক কালে। গগৈয়ের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হেনস্থার অভিযোগ এবং সেই সংক্রান্ত বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সম্প্রতি সংসদেও সরব হয়েছিলেন মহুয়া। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘যে দিন এক জন প্রাক্তন বিচারপতি নিজের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হেনস্থার অভিযোগের বিচার নিজেই করেছিলেন, সে দিনই দেশের বিচার ব্যবস্থার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল’।