প্রতীকী চিত্র
যে মৃত্যু অনিবার্য, তা কি সম্মানজনক হওয়াই বাঞ্ছনীয় নয়! এই প্রশ্নকে সামনে রেখেই শীর্ষ আদালত আজ পরোক্ষ নিষ্কৃতি-মৃত্যুর অধিকার এবং তার জন্য আগাম উইল করার অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিল। এখন থেকে কোনও ব্যক্তি উইল করে বলে যেতে পারবেন, তাঁকে যেন জীবন্মৃত অবস্থায় বাঁচিয়ে রেখে যন্ত্রণা দেওয়া না হয়।
প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র এই ঐতিহাসিক রায়ে বলেছেন, ‘‘স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, জীবন হল প্রদীপের মতো, যা প্রতি মুহূর্তে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অর্থহীন ভাবে বেঁচে থাকা কি সম্মানজনক? মৃত্যুর অন্ধকার সুড়ঙ্গে মাথা উঁচু করে প্রবেশের অধিকার কি থাকতে নেই?’’
তবে সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য প্রত্যক্ষ নিষ্কৃতি-মৃত্যুর অনুমতি অর্থাৎ সরাসরি প্রাণঘাতী ওষুধ দিয়ে মৃত্যু ডেকে আনার অনুমতি দেয়নি। শুধু পরোক্ষ নিষ্কৃতি অর্থাৎ কৃত্রিম শ্বাসগ্রহণ ব্যবস্থা সরিয়ে দিয়ে বা মৃত্যু বিলম্বিত করার ওষুধ বন্ধ করে দেওয়ারই অনুমতি থাকছে।
আগাম উইল কী ভাবে করা যাবে, কী ভাবেই তা কার্যকর হবে— প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাংবিধানিক বেঞ্চ তার নিয়মকানুনও ঠিক করে দিয়েছে। উইল থাকলেও তা কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেবেন চিকিৎসক ও হাসপাতালের মেডিক্যাল বোর্ড। পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়ানো বৃদ্ধ বাবা-মায়ের থেকে মুক্তি পেতে বা কারও সম্পত্তির লোভে যাতে উইলের অপব্যবহার না হয়, হাসপাতালের পরে তাই সরকারি মেডিক্যাল বোর্ডের কাছ থেকেও ছাড়পত্র নিতে হবে। কেউ যদি উইল না করে থাকেন, তাঁর ক্ষেত্রে নিকট আত্মীয় বা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি মেডিক্যাল বোর্ড সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
এত দিন অবধি কোমায় চলে যাওয়া রোগীর পরিজনেরা অনেক সময়ে চিকিৎসার খরচ টানতে না পেরে ব্যক্তিগত ভাবে জীবনদায়ী ব্যবস্থা খুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন চিকিৎসকদের। ব্যক্তিগত বোঝাপড়ায় অনেক সময়ে তা করাও হত। এ বার থেকে কিন্তু তা করতে হলে অনেকগুলো আইনি ধাপ পেরোতে হবে। সে ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি এবং জটিলতা কিছুটা বাড়ার আশঙ্কাও থাকছে।
২০১১-য় অরুণা শনবাগ মামলাতেই সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, কিছু বিরল ক্ষেত্রে সরকারি মেডিক্যাল বোর্ড ছাড়পত্র দিলে হাইকোর্টের অনুমতিসাপেক্ষে পরোক্ষ নিষ্কৃতি মৃত্যু কার্যকর করা যাবে। কিন্তু ‘কমন কজ’ সংগঠনের তরফে জনস্বার্থ মামলা করে প্রশান্ত ভূষণ দাবি তুলেছিলেন, রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুবরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়া হোক। তা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি পাক। আজ সুপ্রিম কোর্ট সেই দাবি মেনে বলেছে, সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুর অধিকার অরুণা শনবাগ মামলার রায়েই স্বীকৃত।
গত বছর সুপ্রিম কোর্ট ব্যক্তি পরিসরের অধিকারকে মৌলিক অধিকার বলে মেনে নেওয়ার পরেই মনে হচ্ছিল, স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারও স্বীকৃত হতে চলেছে। কারণ ওই রায়েই বলা হয়েছিল, ‘সারা জীবন ধরে চিকিৎসা বা ওষুধ-নির্ভরতা প্রত্যাখ্যান করা বা জীবন শেষ করতে চাওয়া ব্যক্তিপরিসরের অধিকারের মধ্যে পড়ে।’ আজ ৫৩৮ পৃষ্ঠার রায়ে উপনিষদ থেকে গ্রিক দর্শন, বলিউডের উপমাও তুলে এনেছেন বিচারপতিরা। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বিচারপতি এ এম খানউইলকর মূল রায় লিখেছেন। বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি এ কে সিক্রি এবং বিচারপতি অশোক ভূষণ পৃথক রায় লিখলেও মূল রায়কেই সমর্থন জানিয়েছেন। এখন কি সংবিধানের ২১-তম অনুচ্ছেদে বর্ণিত জীবনের অধিকারের মধ্যে মৃত্যুর অধিকারও চলে এল? উত্তরে বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছেন, ‘‘জীবন ও মৃত্যু অবিচ্ছেদ্য।’’