ফাইল চিত্র।
উপলক্ষ ছিল নদী সম্মেলন। কিন্তু ভারত এবং বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রীর উপস্থিতিতে শনিবারের গুয়াহাটি কার্যত কূটনৈতিক আলোচনার মঞ্চ হয়ে উঠল।
৪৮ ঘণ্টা পরেই এই দুই রাষ্ট্রের বিদেশমন্ত্রীর মধ্যে যৌথ উপদেষ্টা কমিশনের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল দিল্লিতে। কিন্তু গুয়াহাটি নদী সম্মেলনেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, জলবন্টন ও পারস্পরিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের মধ্যে ঘরোয়া আলোচনা হল। পরে মোমেন জানান, “দিল্লির পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক স্থগিত রাখা হচ্ছে। তা জুনের মাঝামাঝি সময়ে করা হবে। সেখানে আরও বিশদে দুই দেশের মধ্যে ইন্টারনেট যোগাযোগ, বাণিজ্য ও বিদ্যুতের লেনদেন-সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।”
তবে কূটনৈতিক পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক এ ভাবে শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে যাওয়ার কোনও রীতি নেই। ঘটনাটি বিরলই। কেন তা ঘটল তা নিয়ে রাত পর্যন্ত নীরবই থেকেছে সাউথ ব্লক। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, বিষয়টি এমন নয় যে দু’দেশের মধ্যে সুর কেটেছে। বিদেশমন্ত্রীর সময়ঘটিত কিছু জটিলতা এসে যাওয়াতেই এই সিদ্ধান্ত। তবে দিন কুড়ির মধ্যেই এই বৈঠক হবে।
বিষয় যখন নদী, আজ সাংবাদিকদের সঙ্গে মোমেনের আলোচনায় অবধারিত ভাবে উঠে এসেছে তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গ। উত্তরে কিছুটা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তিনি চিন প্রসঙ্গ তুলেছেন। তিস্তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ না করে সাংবাদিকদের মোমেন বলেন, “আমরা আশাবাদী ভারত সমাধানসূত্র বের করতে পারবে। বিভিন্ন সূত্রে শুনছি চিনও নদীশক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে উৎসাহী। প্রস্তাব এলে বিবেচনা করা হবে।” পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য, “বাংলাদেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতু তৈরিতে সবচেয়ে কম দর হাঁকায় তৈরির দায়িত্ব পেয়েছে চিনের একটি সংস্থা। তা নিয়ে অপপ্রচার চলছে যে চিন সেতু বানাচ্ছে। তা ঠিক নয়। বাংলাদেশ নিজের টাকায় সেতু তৈরি করছে। বাংলাদেশ উন্নয়নের স্বার্থে চিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখে। সেখান থেকে অনেক পণ্য সস্তায় পায়। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক পুরনো ও সুদৃঢ়।”
তাঁর কথায়, ‘‘ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশই নদী নির্ভর। বাংলাদেশ পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতায় বিশ্বাসী। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার নিয়ে চুক্তি তারই উদাহরণ।’’ বলেন, “আমরা উত্তর-পূর্ব ভারত হয়ে নেপাল-ভুটান পর্যন্ত বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরিতে আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমল ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়। কোভিডের মধ্যে আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হাজির ছিলেন। যা আগে কখনও ঘটেনি।” পাশাপাশি ভারতের উদ্দেশে বার্তা দিয়ে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ তুলেছেন মোমেন। জানিয়েছেন, “মানবিকতার খাতিরে এত মানুষের খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। শরণার্থীদের একাংশ হতাশ হয়ে বিভিন্ন সমাজবিরোধী কাজে লিপ্ত হচ্ছেন। সমস্যা সমাধানে সকলের সাহায্য প্রয়োজন।”
অন্য দিকে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর আজ তাঁর বক্তৃতায় ভারত তথা সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক বিকাশে বাংলাদেশের অপরিসীম গুরুত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, “আমরা জুনের বৈঠকে উন্নয়নের বিষয়গুলির সার্বিক মূল্যায়ন করব।” সেইসঙ্গে ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংযোগের লাভজনক দিকটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তাঁর মতে, ভারতের উত্তর-পূর্ব থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে জলপথ ও মায়ানমারের সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগ পুরোদমে চালু হলে সমগ্র উপ-মহাদেশেরবাণিজ্য ও অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে। কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে ভৌগোলিক বাধা দূর করে একেবারে পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত আসিয়ান দেশগুলি ও জাপানকে নিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির ঐতিহাসিক প্রয়াস সফল হবে।
অনুষ্ঠানে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলেন, “বাংলাদেশের সাহায্য ছাড়া অসমে সন্ত্রাস দমন সম্ভব হত না। রাজ্যের অর্থনীতিতেও বাংলাদেশের বড় ভূমিকা রয়েছে। অসম সরকার অরণ্য, চা, নদী ও স্বাস্থ্য পর্যটনে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। জলসম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও বন্যা-ভূমিক্ষয় রোধ উভয়ের পক্ষেই বড় চ্যালেঞ্জ।” ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মহম্মদ ইমরান পারস্পরিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির উপরে জোর দেন। বলেন, “অসমে সন্ত্রাস দমন ও শান্তি ফেরানো তো বটেই ভারতের জলপথ সুরক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।”
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।