কমেছে নিত্যসামগ্রীর কেনাকাটা। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
অর্থনীতির দুরবস্থা নিয়ে সরকারি সমীক্ষা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ ফের উঠল নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে।
অর্থনীতির ঝিমুনি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, মানুষ খরচ কমিয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের বাজারে ভাটার টান। সরকারি সমীক্ষাও বলছে, নোট বাতিলের পরে ২০১৭-১৮ সালে আমজনতার সংসার-খরচ কমে গিয়েছে। নুন-চিনি-তেল-মশলা থেকে শুরু করে জামাকাপড়-বাড়িভাড়া এমনকি পড়াশোনার খরচেও কাটছাঁট করছেন সাধারণ মানুষ। গত চার দশকে এমন ঘটনা আর ঘটেনি।
কিন্তু সেই সমীক্ষা প্রকাশ করেনি মোদী সরকার। সংবাদমাধ্যমে তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরে কেন্দ্র জানিয়ে দিল, অনেক খামতি থাকায় এই সমীক্ষা খারিজ করা হয়েছে। এই প্রথম জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর (এনএসও)-এর কোনও পরিসংখ্যান খারিজ করল কেন্দ্রীয় সরকার। পরিসংখ্যান মন্ত্রক বিবৃতি দিয়ে বলেছে, আগামী দু’বছর এই সমীক্ষা চালানো যুক্তিযুক্ত কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেটা হলে ২০২২ সালের আগে দারিদ্র সংক্রান্ত কোনও তথ্যই মিলবে না। তবে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন আজ কবুল করেছেন, ‘‘অর্থনীতির ঝিমুনি পিছনে চলে গিয়েছে, তা এখনই বলাটা তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে।’’
আরও পড়ুন: জোট গঠন আরও এগোল, উপমুখ্যমন্ত্রিত্বে ‘রাজি’ এনসিপি এবং কংগ্রেস
অর্থনীতিবিদদের মতে, সমীক্ষা সঠিক হলে দেশের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ এখন দারিদ্রসীমার নীচে। দরিদ্র মানুষের হার অন্তত ১০ শতাংশ বিন্দু বেড়েছে। এনএসও-র সমীক্ষা বলছে, ২০১৭-১৮ সালে মাথাপিছু মাসিক খরচ ২০১১-১২ সালের তুলনায় প্রকৃত অর্থে (অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধি গণ্য করার পরে) ৫৫ টাকা কমেছে। সামগ্রিক ভাবে খরচ কমার হার ৩.৭%। গ্রামাঞ্চলে ৮.৮% । জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান পি সি মোহননের মতে, মাসিক খরচ কমে যাওয়ার অর্থ, দারিদ্র বেড়েছে। ধনীরা সংসার খরচ কমাবেন, এমনটা সাধারণত হয় না। আয়ের দিক থেকে নীচের সারিতে থাকা ১০ থেকে ২০% মানুষই খরচ কাটছাঁট করেন।
এনএসও-র ‘হাউসহোল্ড কনজাম্পশন এক্সপেন্ডিচার সার্ভে’ হয়েছিল ২০১৭-র জুলাই থেকে ২০১৮-র জুন পর্যন্ত। সমীক্ষা অনুযায়ী, গ্রামে-শহরে মানুষ ভোজ্য তেল, নুন, চিনি, মশলা কেনায় খরচ কমিয়েছেন। গ্রামে জামাকাপড়, শিক্ষা, বাড়িভাড়ার পিছনেও খরচ কমেছে। এর আগে এ রকম খরচ কমার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭২-৭৩-এ, আন্তর্জাতিক জ্বালানি সঙ্কটের সময়। তার আগে ষাটের দশকে। খাদ্যসঙ্কটের সময়।
২০১৬-এ নোটবন্দির পর থেকেই গ্রামে রোজগার কমেছে, বেকারত্ব বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। ২০১৭-১৮-র সমীক্ষা বলেছিল, নোট বাতিলের পরে ৪৫ বছরে বেকারির হার সর্বোচ্চ হয়েছে। কিন্তু লোকসভা ভোটের আগে সেই সমীক্ষা প্রকাশ হয়নি। সে বারও রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। পরিসংখ্যান মন্ত্রক তখনও বলেছিল, সমীক্ষার রিপোর্ট চূড়ান্ত হয়নি। ভোটের পরে তা প্রকাশ করলেও কেন্দ্র বলেছিল, এই বেকারির হার অতীতের বেকারির হারের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।
আজ রাহুল গাঁধী মন্তব্য করেছেন, ‘‘মোদীনমিক্সে এত দুর্গন্ধ বের হচ্ছে যে সরকারকে নিজের রিপোর্টই লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে।’’ সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির কটাক্ষ, ‘‘নোট বাতিলে যে কালো টাকায় টান পড়েনি, গরিবের পেটে টান পড়েছে, তা আগেই জানতাম। এ বার সরকারি পরিসংখ্যানও সেটা চেঁচিয়ে বলছে।’’
পরিসংখ্যান মন্ত্রকের বক্তব্য, এই বছরটি সমীক্ষার জন্য ধরা ঠিক হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে সরকার কি মেনে নিচ্ছে নোট বাতিল ও তার পরে জিএসটি চালুর কারণে অর্থনীতিতে ধাক্কা লেগেছিল। বিরোধীদের অভিযোগ, সেই ধাক্কার জেরেই এখন অর্থনীতিতে ঝিমুনি ধরেছে। পরিসংখ্যান মন্ত্রকের যুক্তি, খরচের ধরন ও দিশা দুই-ই বদলেছে।
এ দিনই সরকারকে স্বস্তি দিয়ে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের চেয়ারম্যান এন কে সিংহ বলেছেন, ‘‘আমার মনে হয় না, এই ঝিমুনি দীর্ঘদিন চলবে।’’