সেই স্মৃতি এখনও তাজা। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
ছত্রপতি শিবাজি এয়ারপোর্ট থেকে কোলাবার মহারাষ্ট্র পুলিশের হেডকোয়ার্টার। প্রায় ২৬ কিলোমিটার। দুপুর ১২টার মধ্যে পৌঁছতেই হবে। ঘড়িতে সকাল সাড়ে ৯টা প্রায়। দৌড়ে ট্যাক্সি নিলাম। কোথায় কী? অস্বাভাবিক জ্যাম, স্পিড ৩০-এর বেশি উঠছেই না! ‘ভাইসাব দুসরা কোই রাস্তা হ্যায় ইধার?’ ড্রাইভার বেশ গম্ভীর, ভিউফাইন্ডারে অনেক ক্ষণ ধরে দেখেই চলেছে। ঝাঁকড়া চুল-দাড়িওয়ালা একটা লোক এয়ারপোর্ট থেকে নেমেই পুলিশের সদর দফতরে যাচ্ছে, হাতে আবার একটা ট্রলি, সেটা ডিকিতেও নেয়নি। সন্দেহজনক তো বটেই! সুতরাং কোনও উচ্চবাচ্যই নেই। বারে বারে মোবাইল ফোন থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু একটানা ব্যস্ত। অবশেষে পৌনে ১টা নাগাদ পৌঁছলাম মুম্বই পুলিশের সদর দফতরে।
১১ই মার্চ, ২০০৯। টানা ৫৬ ঘণ্টার ভয়াবহ ‘যুদ্ধ’-এর তিন মাস পরে। সম্বল একটা এসএমএস। স্পেশাল আইজিপি (আইনশৃঙ্খলা)-র নাম, ফোন নাম্বার। পাঠিয়েছেন এনএসজি-র এক উচ্চপদস্থ কর্তা। পাঠিয়েছেন বললে ভুল হবে, পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন— একটানা দেড় মাস নাছোড়বান্দা ‘আবদারের’ ঠেলায়।
আরও পড়ুন:
যে ১০ জঙ্গিহানায় রক্তাক্ত হয়েছিল দেশ
রিসেপশন কাউন্টারে জানাতেই বলল, ‘থার্ড ফ্লোর-লিফ্টমে যাও!’ আইজিপি হাতের ইশারায় বসতে বললেন। তাকালেন আমার দিকে। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি-সহ্য করা মুশকিল-অস্বস্তি কাটাতে বলে ফেললাম, ‘‘নাইস রুম, সম্ভবত আগে দেখেছি-ওয়েডনেসডে সিনেমায়...।’’ ‘২৬/১১ ওয়াজ নট আ সিনেমা...ইওর ব্যাকগ্রাউন্ড?’ ধড়ে প্রাণ এল। দ্রুততার সঙ্গে রেজাল্ট-প্রেসিডেন্সি-ফিজিক্স-এমবিএ-নাটক-সাংবাদিকতা-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গবেষণাধর্মী শিল্পসৃষ্টি ইত্যাদি-প্রভৃতি ঝুলিতে যা ছিল সব একনিমেষে বলে ফেললাম। ‘গুপ্তাসাব টোল্ড মি টু হেল্প ইউ-হোয়াট হেল্প ডু ইউ নিড?’ আমতা আমতা করে বলেই ফেললাম, সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পড়ছি-লিখছি-বোঝার চেষ্টা করছি, কিন্তু সবটাই যে ‘পুঁথি পড়া বিদ্যে’-বাস্তব ভয়াবহতাটা যে রক্তমাংসের অনুভূতির বাইরে!
‘ইউ ওয়াণ্ট রিয়েলিটি, বাট ইট’স নট আ শো! ওকে কাম অন!’ ভারী দরজা ঠেলে বেরোলেন, পিছনে আমি। উনি হাঁটছেন–আমি দৌড়চ্ছি। অনেকটা মঞ্চের ড্রপসিনের মতো একটার পর একটা পর্দা উঠে যাচ্ছে। পরের তিন দিন এক ভয়ানক যুদ্ধক্ষেত্রের নানা সীমানায় পৌঁছে যাওয়ার দুর্মর অভিজ্ঞতা। সবটাই ক্লাসিফায়েড। শুরু করেছিলেন কনফারেন্স রুমে, ধৃত জঙ্গি আজমল কাসভের ২ ঘণ্টার একটানা জিজ্ঞাসাবাদের অসম্পাদিত ভিডিও দিয়ে, শেষ করলেন আর্থার ফোর্ট জেলের স্পর্শকাতর ১২ নম্বর ব্যারাকে এসে।
যাঁরা আমাকে এই ফ্রি প্যাসেজটা দিয়েছিলেন, সন্ত্রাসবিদ্ধ পৃথিবীর বুকে একটা নতুনতর শিল্পসৃজনের ক্যানভাস তৈরির জন্য, তাঁরা কেউই জানতেন না যে আমি কোনও নাট্য উপাদানের খোঁজে মুম্বই যাইনি। যদিও প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পিয়ানোর রিডে যে স্বরলিপি তৈরি করা সম্ভব সেই অনবদ্য শিল্পীর সন্ধান দিয়েছিল কিন্তু সেই মুম্বই পুলিশের এটিএস বিভাগেরই কয়েক জন। আসলে ২৬/১১-র মুম্বই হামলার যত ছবি-ভিডিও-লেখা এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে, তার কয়েক হাজার গুণ বেশি তথ্য অপ্রকাশিত অবস্থায় আজও ‘ক্লাসিফায়েড’।
ঘটনাটিকে কেন সন্ত্রাসবাদী হানার বদলে ভয়াবহ ‘যুদ্ধ’ বলছি, তার পিছনে রয়েছে নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা, আর অবশ্যই ২০০৮-’১৭ পর্যন্ত পৃথিবীর নানা দেশের ছোট-বড় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্যের নির্মেদ উন্মোচন। যে প্রশ্নগুলির উত্তর এখনও কোথাও নেই।
১) মুম্বই পুলিশের সাহায্যে ‘তাজ’ হোটেলের ভিতরে ঢুকে যে দৃশ্য দেখেছিলাম, তাতে মনে হয়নি এটা চার জন জঙ্গি বনাম এনএসজি কমান্ডোদের আক্রমণের বধ্যভূমি! হোটেলের এক-একটা ঘরের ভারী দরজা কয়েকশো বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে কাপড়ের পর্দার মতো ঝুলছে। টোকা দিলে পড়ে যাবে। দোতলা থেকে তিন তলায় ওঠার বিশাল সিঁড়িটাই বিস্ফোরণে উড়ে গেছে। দোতলায় ১৮টি ঘরে ঢোকার সুযোগ হয়েছিল। বাথরুম-শোওয়ার খাট-আসবাব সমস্তটাই ধূলিসাৎ। কত হাজার টন বিস্ফোরক ব্যবহার করলে এ ভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব? প্রশ্ন হচ্ছে, মাত্র চার জন, ব্যাকপ্যাক আর ছোট ব্যাগে কী ভাবে এই বিপুল বুলেট-বিস্ফোরক নিয়ে তাজ হোটেলে প্রবেশ করেছিল? এনএসজি-র যে ২৯৫ জন মেরিন কমান্ডো তাজ ও ট্রাইডেণ্ট হোটেলে যুদ্ধ চালিয়েছিলেন, তাঁদের আফগান সীমান্ত থেকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয়, কারণ তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে অভিজ্ঞ। একটানা ৩৬ ঘণ্টা সময় লেগেছিল চার জঙ্গিকে কব্জা করতে, মূল অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ১০০ বছরের পুরনো তাজ হোটেলের যাবতীয় ম্যাপ, যেটা সঠিক ভাবে পাওয়া যাচ্ছিল না। অথচ সেই ম্যাপ জঙ্গিদের কাছে (যা ল্যাপটপে সেভ করা ছিল) পৌঁছে গেল কী ভাবে? যার জন্য তারা প্রতিটি লুকনো করিডর-দরজার হদিশ আগে থেকেই জেনে গিয়েছিল।
২) রহস্যময়ী মহিলাটি কোথায়? ২৬ নভেম্বর ২০০৮। এক জন পুরুষ এবং সালোয়ার কামিজের ওপর বোরখা ঢাকা এক মহিলা কামা হাসপাতাল আক্রমণ করে। সিসিটিভি ফুটেজের যে অংশটি উদ্ধার করা গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে বোরখা পরা মহিলাটি মোবাইল ফোনে কথা বলছে। সময় ১০টা ৩৫ মিনিট। কোথায় গেল এই মহিলা? ঠিক পর দিন যখন কাসভের সঙ্গী নিহত জঙ্গি ‘আজম’-এর ছবি কাগজে প্রকাশিত হয়, তখন নরিম্যান হাউস বা শাবাদ হাউসের সামনের বাজারের এক দোকানদার পুলিশের কাছে গিয়ে লিখিত বয়ান লিপিবদ্ধ করে যে, আগের দিন বিকেলে আজম এক মহিলাকে নিয়ে তাঁর দোকানে আসে এবং ২০ কেজি ময়দা, ৫০ প্যাকেট বিস্কুট, ১০ কেজি খেজুর কেনে। এই মহিলাটি কি সেই মহিলা, যাকে কামা হাসপাতালে দেখা গিয়েছিল? কিন্তু শাবাদ হাউসে জঙ্গি আক্রমণ প্রতিহত করার পর এনএসজি কমান্ডোরা যে দেহগুলিকে বার করে আনেন, তার মধ্যে রাব্বি হোলজৎবারগের স্ত্রী রিভকা ছাড়া কোনও মহিলার দেহ ছিল না। জীবিত এক জনই মহিলা শাবাদ হাউস থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন দু’বছরের শিশু ‘মোসেকে’ কোলে নিয়ে, তাঁর নাম সান্দ্রা স্যামুয়েল, যিনি নিজেকে বাচ্চাটির নানি বলে পরিচয় দেন এবং যাঁকে ইজরায়েল সরকার সে দেশে নিয়ে যায়। তা হলে ওই মহিলাটি কে? কোথায়ই বা গেল সে?
৩) অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শীই বা কোথায়? অনিতা উদ্দাইয়া, ২৩ বছরের তরুণী, বিকেল ৪টে নাগাদ দেখেন, ছ’জন লোক বড় বড় ব্যাগ নিয়ে গলিপথ দিয়ে শাবাদ হাউসে ঢুকে যাচ্ছে। এরা অনিতার কাছে খাবার জল চেয়েছিল, তিনি দিয়েওছিলেন। ঘণ্টাখানেক বাদে এদের মধ্যে চার জন কাছাকাছি মাংসের দোকানের খোঁজ করে। অনিতা দেখিয়েও দেন। ২০০৮-এর ৩০ নভেম্বর পুলিশ মর্গে গিয়ে অনিতা উদ্দাইয়া ছয় মৃত জঙ্গিকে শনাক্ত করেন, তাঁর বয়ান পুলিশ রেকর্ডে অন্যতম সাক্ষী হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। অথচ তিন দিন বাদে ৩ ডিসেম্বর সেই অনিতা উদ্দাইয়াকে ‘তদন্তকে ভুল পথে প্রভাবিত’ করার অভিযোগে থানায় ডেকে হুমকি দেওয়া হয়। যাবতীয় বয়ান প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এখানেই শেষ নয়, ওই রকম সময়ে, যখন মুম্বই ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া প্রায় অসম্ভব, তখন ৮ ডিসেম্বর অনিতা উদ্দাইয়া আমেরিকায় চলে যান। অভিবাসন দফতরের রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, ওই দিনই তাঁর ভিসা মঞ্জুর হয়েছে। কে তাকে নিয়ে গেল? কেন? আজ পর্যন্ত এই মহিলার কোনও হদিশ নেই।
৪) এটিএস প্রধান হেমন্ত কারকারেকে কে ডেকেছিল? আক্রমণের দিন যখন হেমন্ত কারকারে পুলিশের সদর দফতরে, একটার পর একটা আক্রমণের খবর আসছে, সে সময় ওই রকম অভিজ্ঞ এক জন পুলিশ অফিসার কীসের জন্য একটা নির্দিষ্ট ফোন পেয়ে কামা হাসপাতালের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন ? যখন কামা হাসপাতালে আক্রমণ হয়েছে, এ রকম কোনও খবরই মুম্বই পুলিশের কন্ট্রোল রুমে আসেনি। কে-ই বা খবর দিয়েছিল সন্ত্রাসবাদী কাসভদের যে হেমন্ত কারকারে রঙ্গভবন লেন দিয়ে কামা হাসপাতালের দিকে আসছেন? তারা রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের নীচে লুকিয়েছিল এবং গুলি করে হেমন্তকে খুন করে। যদিও ময়নাতদন্তে কারকারের গায়ে যে বুলেট পাওয়া যায় তা ৯ এমএম বুলেট, যা ভারতীয় পুলিশ ব্যবহার করে। এখানেই শেষ নয়, শাবাদ হাউসের ঠিক উল্টো দিকের বাড়ির বাসিন্দা আনন্দ রাওয়ানে পুলিশের কাছে বিবৃতি রেকর্ড করেন, যে মুহূর্তে হেমন্ত কারকারের খুন হয়ে যাওয়ার খবর টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠে, সেই মুহূর্তে শাবাদ হাউসে হাততালি দিয়ে অনেক লোক চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে। প্রশ্ন এখানেই, তাজ-ট্রাইডেন্ট–এর পাশাপাশি হেমন্ত কারকারেও কি অন্যতম টার্গেট ছিলেন?
আট বছর কেটে গিয়েছে, ধৃত কাসভের ফাঁসি ছাড়া আতঙ্কিত মানুষের কাছে স্বস্তির খবর কিছুই নেই। তদন্ত কি আদৌ হচ্ছে? কেউ জানে না। ভারতের পক্ষ থেকে প্রধান অভিযুক্ত লস্কর-ই-তৈবার কমান্ডার জাকিউর রহমান লাকভি ও হাফিজ সইদ বর্তমানে জেল থেকে ছাড়াও পেয়ে গিয়েছে। আর এক অভিযুক্ত ডেভিড কোলম্যান হেডলি আমেরিকার জেলে বন্দি। তাকে স্কাইপ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদ করার কোনও অধিকার ভারত সরকারের নেই। একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করে তদন্ত চালানোর কোনও সদিচ্ছা আজ পর্যন্ত নেই। ঘটনার পরের মুহূর্ত থেকে যে লড়াইটা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধের অদম্য জেদ নিয়ে গড়ে উঠতে শুরু করেছিল তা এখন কূটনৈতিক খেলায় ভারত-পাকিস্তানের ‘সেন্সিটিভ কনফ্লিক্ট’ হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিতে ক্রমশ এগোচ্ছে।
ব্যক্তিগত ভাবে খুব মনে পড়ে, মুম্বই থেকে যে নাট্য উপাদানটি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম, যাকে ঘিরে অনেক তথ্য জোগাড়ের পর ‘ফিঙ্গারপ্রিন্টস ২৬/১১’ নামক বাংলা নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলাম, তার মূল ফাইলটা যে এটিএস অফিসার আমায় দেখতে দিয়েছিলেন, তাঁর কথা! ঝকঝকে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “আমরা গুলি খেয়েছি–মারা গেছি–কিন্তু কেউ চোখের জল ফেলিনি–আমাদের পাশে থাকার সাহসটা শেষ পর্যন্ত রাখবেন তো?”
‘সাহস’ এখন কোন পাখির ডানায় ভর করে আকাশের কোন দিকে উড়ছে?
(যাবতীয় প্রশ্নের তথ্যসূত্র: ‘চয়েসেস: ইনসাইড দ্য মেকিং অফ ইন্ডিয়ান ফরেন পলিসি’— শিবশঙ্কর মেনন, কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (সিবিসি), গার্ডিয়ান, ডিএনএ, মিড-ডে নিউজ, নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, দ্য টাইমস, জেরুজালেম পোস্ট, ইকনমিক টাইমস, সিএনএন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্য টেলিগ্রাফ, গ্রেটগেমইন্ডিয়া।)