বিশেষ অধিবেশন সংসদ চত্বরে অভিনেত্রী তমন্না ভাটিয়া-সহ অনেকে। ছবি: পিটিআই।
লোকসভার পরে রাজ্যসভাতেও মহিলা আসন সংরক্ষণ বিল পাশ হয়ে গেল। কিন্তু কবে থেকে আসন সংরক্ষণ চালু হবে, তার উত্তর মিলল না। তবে আজ থেকেই সংসদে বিলটি পাশ করানোর যাবতীয় কৃতিত্ব নরেন্দ্র মোদীকে তুলে দিতে মাঠে নেমে পড়ল শাসক শিবির। মহিলা সংরক্ষণের সঙ্গে মোদীর নাম অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে দিয়ে বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায় বিল পাশের সময় চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড় প্রধানমন্ত্রীর সামনেই ঘোষণা করলেন, হিন্দু তিথি অনুযায়ী আজই নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিন। যদিও সরকারি ভাবে মোদীর জন্মদিন চলে গিয়েছে ১৭ তারিখেই।
আজ রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ বিলটি আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজ্যসভায় পাশ হওয়ার পরেই এই বিশেষ অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ মহিলা বিল ছাড়া এই অধিবেশনে আর কোনও বিলই এল না। মহিলা সংরক্ষণ বিলে সমর্থন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ লোকসভায় সব দলকে ধন্যবাদ জানান। একই ভাবে রাজ্যসভাতেও বিল পাশের আগে মোদী সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সর্বসম্মতিতে বিল পাশের জন্য আবেদন জানান। বিল পাশ হওয়া মাত্র গোটা ট্রেজ়ারি বেঞ্চ ‘মোদী মোদী’ জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়ে। বিজেপি সূত্রের খবর, এখন থেকেই মোদীকে এর যাবতীয় কৃতিত্ব দিয়ে বিজেপি গোটা দেশে প্রচারে নেমে পড়বে। শনিবার মোদী নিজে তাঁর লোকসভা কেন্দ্র বারাণসীতে বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধনে যাবেন। সেখানেও তিনি নিজে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ করানোর সাফল্যের ঢাক পেটাবেন।
মহিলা সংরক্ষণ বিল বা সংবিধানের ১২৮তম সংশোধনী বিলটি পাশ হওয়ার পরে এ বার তা অন্তত অর্ধেক সংখ্যক রাজ্যের বিধানসভাতেও অনুমোদিত হবে। কিন্তু বিলটি কার্যকর কবে হবে? বিলে বলা হয়েছে, জনগণনা ও আসন পুনর্বিন্যাসের পরেই তা কার্যকর হবে। বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা আজ রাজ্যসভায় দাবি করেছেন, ২০২৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সময় তিন ভাগের এক ভাগ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুনরাম মেঘওয়াল বা মোদী সরকারের কোনও মন্ত্রী এ নিয়ে নির্দিষ্ট উত্তর দেননি। বিরোধীদের অভিযোগ, ২০২৪-এর নির্বাচনে মহিলা ভোট জেতার জন্য ভোটের ছয় মাস আগে বিল পাশ করানো হচ্ছে। অথচ এখন যাতে তা কার্যকর না হয়, তার জন্য জনগণনা, আসন পুনর্বিন্যাসের শর্ত লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোদী সরকারের শীর্ষ সূত্রের বক্তব্য, এই বিলের মাধ্যমে ২০২৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে জনগণনার ভিত্তিতেই আসন পুনর্বিন্যাসের রাস্তা খোলা হয়েছে। ২০২৪-২৫-এর জনগণনা হয়ে গেলে ২০২৬-এর পরে আসন পুনর্বিন্যাসে বেশি সময় লাগবে না। তাই ২০২৯-এর লোকসভা নির্বাচনে মহিলা সংরক্ষণ কার্যকর করা সম্ভব।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে যে, ২০২১-এর জনগণনা ২০২৪-২৫-এ হওয়ার কথা। ২০২৬ পর্যন্ত আসন পুনর্বিন্যাস বন্ধ করা রয়েছে। তার পরের জনগণনা অনুযায়ী আসন পুনর্বিন্যাস হওয়ার কথা। যার অর্থ, ২০৩১-এর জনগণনার পরে আসন পুনর্বিন্যাস হবে। আসন পুনর্বিন্যাস কমিশন গত বারের মতো পাঁচ বছর সময় নিলে ২০৩৪-এর লোকসভা নির্বাচনও পেরিয়ে যাবে। যার অর্থ, ২০৩৯-এর লোকসভায় মহিলা সংরক্ষণ কার্যকর হবে। তা হলে এই বিল নিয়ে এখন এত হইচই কেন? বিরোধীরা তোপ দাগলেও মোদী সরকারের শীর্ষ কর্তারা মনে করছেন, মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ করানোর সুফল এই ভোটে কুড়োনো যাবে। কবে থেকে আসন সংরক্ষণ কার্যকর হবে, সেই প্রশ্ন প্রচারের বাদ্যিতে ধামাচাপা পড়ে যাবে। ইউপিএ আমলে বিল পাশ করানোর চেষ্টা হয়েছিল বলে প্রচার কাজে আসবে না। মোদী নিজে বলেছেন, ঈশ্বর তাঁকেই এই পবিত্র কাজের জন্য বেছে নিয়েছেন। এ দিন রাতে এক্স হ্যান্ডলে মোদী রাজ্যসভায় এই বিল পাশের জন্য সকল সাংসদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। লিখেছেন, ‘এই বিল পাশ হওয়ায় নারীশক্তির প্রতিনিধিত্ব আরও জোড়ালো হবে এবং তাঁদের ক্ষমতায়নে নতুন জুগের সূচনা হবে’।
আজ বিরোধী শিবির অভিযোগ তুলেছিল, বিজেপির অন্দরমহলে মহিলা সংরক্ষণ নিয়ে ঐকমত্য নেই। অতীতে অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণীরা পঞ্চায়েতে মহিলা সংরক্ষণের বিরোধিতা করেছিলেন। ইউপিএ সরকারের আমলে যোগী আদিত্যনাথ লোকসভা, বিধানসভায় মহিলা সংরক্ষণের বিরোধিতা করেন। ২০১৪-এ মহিলা সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও মোদী সরকার সাড়ে ন’বছর উদ্যোগী হয়নি। এখন এত গোপনীয়তার দরকার ছিল না।
মহিলা সংরক্ষণ বিলকে সমর্থন করলেও কংগ্রেসের ৯ জন সাংসদ আজ তা অবিলম্বে কার্যকরের দাবিতে বিলে সংশোধনী এনেছিলেন। কিন্তু তা ধোপে টেকেনি। মহিলা বিলের মধ্যে ওবিসি সংরক্ষণ রাখার দাবিও ফলপ্রসূ হয়নি। কংগ্রেস সাংসদ কে সি বেণুগোপালের অভিযোগ, আদানি কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসতেই মোদী সরকার নজর ঘোরাতে মরিয়া চেষ্টা শুরু করেছে। প্রথমে এক দেশ, এক ভোট। তার পরে মহিলা সংরক্ষণ। আদানি কেলেঙ্কারি থেকে নজর ঘোরানোর অভিযোগ তুলেছেন আপ সাংসদ সন্দীপ পাঠকও। তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েনের প্রশ্ন, সংসদে বিল পাশ করানো গণতন্ত্রের প্রক্রিয়া। তা হলে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ করানো নিয়ে এত গোপনীয়তা কেন! মণিপুরের ঘটনা, ধর্ষণ, কুস্তিগিরদের হেনস্থার সময় মোদীর নীরবতা, নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী শিবিরের একের পর এক মহিলা সাংসদ। কংগ্রেস সাংসদ রঞ্জিত রঞ্জন বলেন, ‘‘মোদী সরকার মহিলাদের ক্ষমতায়ন, সমানাধিকারের কথা বলে। কিন্তু মণিপুরের ঘটনা, ধর্ষণ, কুস্তিগিরদের রাস্তায় ফেলে হেনস্থার সময় এই সরকারের মহিলা মন্ত্রীদের মুখ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।’’