ছবি: পিটিআই।
এ বারের মতো এতটা দেরি বর্ষার বোধহয় আর কখনও হয়নি। কেন যেন হিসেব বলছিল, যখন আসবে ভাসিয়ে নেবে। হলও তাই। দু’দিনের মধ্যেই বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ল। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। শুধু গত ১২ ঘণ্টাতেই ৩০১.৪ মিমি বৃষ্টি।
আজ ভোর থেকেই ‘পাওয়ার কাট’। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরমও করতে পারছিনা, ইলেকট্রিসিটিতেই বার্নার জ্বলে... হাতড়ে টর্চটা বের করলাম, ব্যাটারি কম! টিমটিমে আভায় ড্রয়ার থেকে ব্যাটারি বার করলাম। ঠাকুরের আসনের ড্রয়ার থেকে দেশলাই বার করে গ্যাস জ্বালালাম। ইন্টারকমে আবাসনের রক্ষীকে ফোন করে জানলাম, বিস্তীর্ণ এলাকাই অন্ধকার আর পাম্পও চলবে না। জল শোধনের যন্ত্রও নয়। রান্নাঘরে ঢুকে দেখি, একটা মাত্র বোতলে কিছুটা জল পড়ে। সামনের ২৪ ঘণ্টার ওষুধের দোকান। ফোন করলাম, জলের বোতলের জন্য। দেরি হলে লাইন পড়ে যাবে! দোকান থেকে বলল, ওদের ডেলিভারি বয় আসেননি।
এ দিকে আমাদের লিফট বন্ধ। সিঁড়ি জলে থই থই করছে। এই অল্প আলোয় জলের মধ্যে দিয়ে এতটা নিচে নামা সাহসে কুলালো না। আর একটা দোকানে ফোন করে জল চাইলাম। তাঁরা সাফ জানিয়ে দিলেন, লিফট না চললে তাঁরা আসবেন না। কথা হল, লিফট চললে আর জল চাইব কেন? এক ডেকচি কলের জল নিয়ে গ্যাসে চাপিয়ে দিলাম।
ভাবছিলাম, সেই প্রাণঘাতী বন্যার পর ১৪ বছর হয়ে গেল, অবস্থা কি খুব একটা ফিরল আমাদের! সরকার প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়েছে, অবস্থা ফিরেছে মিঠি নদীর, তবুও রাস্তা জলে ডুবে গিয়েছে, স্কুল, কলেজ, অফিসে ছুটি। দেশের সব থেকে সমৃদ্ধশালী বৃহন্মুম্বই মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন সাম্প্রতিক ৩০,০০০ কোটি টাকার বাজেটে নিকাশি, বর্জ্য শোধন ইত্যাদিতে বরাদ্দ রেখেছে। কিন্তু প্রতি বছর বর্ষার সময়ে মুম্বইয়ের জনজীবন যে কে সেই। কখনও ফুট ওভারব্রিজ ভেঙে পড়ছে, কখনও টানা দু’দিনের বৃষ্টিতে রাস্তায় বুক সমান জল হয়ে জনজীবন অচল!
প্রায় ২০ বছর মুম্বইয়ে রয়েছি। চোখের সামনে তাকে আরও উন্নত হতে দেখেছি। শহরের সমস্ত জঞ্জাল যেখানে ফেলা হত, সেই জায়গাও উন্নত হয়ে এশিয়ার বৃহত্তম শপিং মল হতেও দেখেছি। কিন্তু এ শহরের উন্নয়নের কারিগর, দেশের সমস্ত প্রান্ত থেকে আসা মানুষগুলোকে রক্ষার কতটুকু দায়িত্ব এই রাজ্যের সরকার নিতে পারল? প্রতিটি দুর্যোগে অগণিত মানুষের দুর্ভোগ এবং প্রাণহানির পর কাদা ছোড়াছুড়ি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০০৫ সালে ২৬ জুলাইয়ের অভিজ্ঞতা মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। কয়েক ঘণ্টায় ৯০০ মিমি বৃষ্টিতে গোটা শহর জলের তলায়। তার ওপর প্রবল জোয়ার। শহরের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মিঠি নদী প্লাস্টিক আর জঞ্জালে এমন ভর্তি হয়েছিল যে সমুদ্রে যাওয়ার সব পথের মুখ বন্ধ। এর ফলে যাবতীয় উপচে পড়া নোংরা জলে শহর ভেসে যায়, জোয়ারের ফলে ঢুকে পড়ে সমুদ্রের জল। সব থেকে ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়েছিল জোয়ারের পর। জল ফিরে যাওয়ার সময়ে অনেককে নিয়ে যায়। জল বের করার আশায় ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে দেওয়া হয়েছিল অনেক জায়গায়। অনেকে বুঝতে না পেরে তাতেই পড়ে তলিয়ে যান।
আপাতত আবহাওয়ার যা পূর্বাভাস, আগামী ৪-৫ তারিখ মুম্বইয়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টি, তার সঙ্গে বিশাল জোয়ার।
আমার সামনে পশ্চিমের আকাশটা কালো হয়ে ধেয়ে আসছে...।