গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তিনসুকিয়ায় গণহত্যা কারা ঘটিয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। ঘটনার পরেই জঙ্গি সংগঠন আলফা (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসম)-র পরেশ বরুয়া গোষ্ঠী তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। এ বার আলফা-র আলোচনাপন্থী অংশও দায় ঝেড়ে ফেলল। যদিও অসমের অধিকাংশ বাঙালি সংগঠনের সন্দেহ, আলফা-ই রয়েছে এই ঘটনার পিছনে।
শনিবার সংগঠনের আলোচনাপন্থী অংশের শীর্ষ নেতা অনুপ চেতিয়া আনন্দবাজার ডিজিটালকে জানান, সঠিক তদন্ত হলেই এই ঘটনার পিছনে কারা রয়েছে, তা জানা যাবে। তবে হিংসার মূল কারণ হিসাবে তিনি উস্কানিমূলক মন্তব্যকেই দায়ী করেছেন। আর সেই তালিকায় প্রথমেই রাখছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। তাঁর মতে, তৃণমূল আসলে গোটা বিষয়টার ফায়দা তুলতে চাইছে।
আলফার আলোচনাপন্থী নেতা অনুপ চেতিয়ার সঙ্গে কথা বলল আনন্দবাজার ডিজিটাল।
প্রশ্ন: তিনসুকিয়ায় ৫ জন বাঙালিকে এ ভাবে হত্যা করা হল! কী বলবেন?
অনুপ: এটা উচিত হয়নি। নাগরিক পঞ্জির বিষয়ের পর থেকেই উস্কানিমূলক কথাবার্তা হচ্ছিল। তখন থেকেই আমি বলছিলাম, এতে ক্ষতি হবে নিরীহ মানুষদের। বিশেষ করে বাঙালিদের। যাঁরা শহরে থাকেন, তাঁদের কিছু হবে না। আমার গ্রামের বাড়ির কাছেই ঘটনাটি ঘটেছে। ’৯২ সালে বন্যার সময় উদ্বাস্তু হয়ে ওখানে অনেকে চলে গিয়েছিলেন। যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের অনেক আত্মীয়স্বজনকে আমি চিনি। এমন ঘটনা কখনওই কাম্য নয়।
প্রশ্ন: তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম থেকেই এ বিষয়ে আন্দোলনে নেমেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে ফের তারা পথে নেমেছে। তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন আবারও প্রতিনিধি দল অসমে যাবে।
অনুপ: দেখুন, সহানুভূতি দেখাতে আসতেই পারে। কিন্তু, এখানে এসে যদি আবার ওঁরা উষ্কানিমূলক কথা বলেন, তা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। ওঁরা কিছু দিন পরে আসলেই ভাল!
প্রশ্ন: বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু অসমের বাঙালির পাশে রয়েছেন। বাঙালি খেদাও চলবে না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
অনুপ: আপনাদের মুখ্যমন্ত্রী যা বলছেন, তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। আমি বার বার বলছি, উস্কানিমূলক কথা বলবেন না। তা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে। আসলে এ সবের জন্যেই তো সমস্যা শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন: ‘সামনের গুলিবিদ্ধ মানুষগুলো তখন হামাগুড়ি দিয়ে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, আর আমি...’
প্রশ্ন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালিদের পাশে থাকলে সমস্যা কোথায়?
অনুপ: আমরা কখনও বাঙালিদের বিরুদ্ধে নই। আমরা তাদের সঙ্গে মেলামেশা করি। আমি কিছু দিন আগেই তিনসুকিয়ায় বৈঠক করে এসেছি। বাঙালি সংগঠনগুলির পাশাপাশি বিদ্বজ্জনদের সঙ্গেও কথা বলেছি। সেখানে বলেছিলাম, আপনারা কোনও চিন্তা করবে না। আমরা আসলে সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে চলেছি। এর পর যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলেন, সমস্যা হতেই পারে। পরিস্থিতি কিন্তু খারাপ হচ্ছে, এটা মাথায় রাখতে হবে।
প্রশ্ন: তিনসুকিয়ায় গণহত্যার ঘটনায় কারা জড়িত? আলফা?
অনুপ: আসল ঘটনা আমিও জানি না। কিন্তু যাঁরা জঙ্গলে আছেন, তাঁরা তো নাগরিক পঞ্জি ইস্যুর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবেনই। তার ফলে নিরীহ লোক মরবে। আপনাকে যদি কেউ খারাপ কথা বলে, মারমুখী কথা বলে, তা হলে কি আপনি কোনও পদক্ষেপ করবেন না? যদি আলফা এই কাজ না করে থাকে, তা হলে কে করল? তা হলে কি দ্বিতীয় কোনও দলের হাত রয়েছে? সঠিক ভাবে তদন্ত হলেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
অশান্ত অসম...
প্রশ্ন: আপনি তো এক সময়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। সেই পরিস্থিতির কী বদল হয়নি?
অনুপ: আদর্শগত কারণে গিয়েছিলাম। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী, সে হিন্দু হোক বা মুসলমান, তাঁদের অসম গ্রহণ করেছে। আর কত দিন এ সব চলবে? এখনও অসমের পরিস্থিতির পরিবর্তন হল না। এখনও কেন্দ্রীয় সরকার যে আমাদের অবহেলা করছে সে কথা অস্বীকার করা যায় না। সংসদীয় কমিটির কাছে আমি বলেছিলাম, এনআরসি বিল পাশ করলে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠবে অসম। শুনল না। সে জন্যেই তো এই সমস্যা হল। এর পর এখানকার বাঙালিদের উষ্কানিমূলক কথা বলা উচিত হয়নি।
প্রশ্ন: হোজাইয়ের বিজেপির বিধায়ক শিলাদিত্য দেব কিন্তু বাঙালিদের হয়েই সওয়াল করেছেন।
অনুপ: বিজেপির শিলাদিত্য কিছু দিন আগেই বলেছিলেন, অসমকে কাশ্মীর হতে দেব না। অসমকে ত্রিপুরা বানাব। তার মানে কি? অসমের নাগরিকদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করবে? অসমিয়াদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার জন্য তাদের পরিকল্পনা রয়েছে। আসলে পরিকল্পিত ভাবে এগোচ্ছে বিজেপি। এর পরেই অসমের জনগণ অন্য ভাবে চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছে। তার ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করে। বিজেপি নেতারা যা বলছেন, ঠিক বলছেন না। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয়, লোকসভা ভোটের আগে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে চাইছে?
অনুপ: শুধু বিজেপি বা কংগ্রেস কেন, তৃণমূল এবং সিপিএমও ফায়দা তুলতে চাইছে। এখানে যে তৃণমূল নেতারা রয়েছেন, তাঁরাও চেষ্টা চালাচ্ছেন ফায়দা তোলার।
অনুপ চেতিয়ার এক সময়ের সঙ্গী আলফা নেতা পরেশ বরুয়া (ডান দিকে)।
আরও পড়ুন: আইএস-এ যোগ দিয়েছেন গ্রেটার নয়ডার নিখোঁজ ছাত্র সফি?
প্রশ্ন: শান্তি বজায় রাখতে আপনার পরামর্শ কী?
অনুপ: প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেউ যেন কোনও উস্কানিমূলক মন্তব্য না করেন। যদি কেউ করেন, তার প্রভাব অসমে পড়বেই। আমরা একসঙ্গে মিলে যাতে কাজ করতে পারি সেই চেষ্টা করতে হবে। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই। বাঙালিদের পাশে আছি। আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থাকলে তা মিটিয়ে নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন: আলোচনাপন্থী নেতা মৃণাল হাজারিকা এবং জিতেন দত্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
অনুপ: ওরাও উত্তেজনামূলক কথাবার্তা বলছে। আমার ছেলেদের শান্তি বজায় রাখার কথা বলছি। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রাখতে চাই। অসমে ফের আসুক শান্তি। আমরা কোনও কর্মসূচি নিইনি। আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে।
(১৯৭৯-এর ৭ এপ্রিল পরেশ বরুয়া, অরবিন্দ রাজখোয়া, প্রদীপ গগৈ, ভদ্রেশ্বর গোসাঁই, বুধেশ্বর গগৈয়ের সঙ্গে আলফা গড়েছিলেন অনুপ চেতিয়া ওরফে গোলাপ বরুয়া। ১৯৯২ থেকেই তিনি ফেরার ছিলেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে গ্রেফতার হন অনুপ। সাজার মেয়াদ শেষ হলেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে সেখানকার জেলেই রয়ে গিয়েছিলেনন। বন্দিপ্রত্যার্পন চুক্তি হওয়ার পর, বাংলাদেশ তাঁকে ভারতের হাতে তুলে দেয়। বর্তমানে তিনি আলফার আলোচনাপন্থী অংশের নেতা।)
এই খবর প্রথম প্রকাশের সময় ভৃগু ফুকনের নাম আলফার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে লেখা হয়েছিল। অনিচ্ছাকৃত ওই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত। তিনি অসম গণ পরিষদের নেতা ছিলেন।