Gujarat

পরিচয় ধরে রাখতে লড়ছে এক টুকরো আফ্রিকা

কয়েকশো বছর আগে ক্রীতদাস প্রথার যখন তুমুল দাপট, ভারতে সমুদ্রপথে আনা হয়েছিল আফ্রিকার বেশ কিছু মানুষকে। তবে কারা এনেছিলেন, তা নিয়ে বহুমত।

Advertisement

অগ্নি রায়

জাম্বুর শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২২ ০৬:৪০
Share:

জাম্বুর গ্রামে। নিজস্ব চিত্র

গির থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটে উতরোল মাটির কুটিরে সাজানো গ্রামটি। অরণ্যের কোলঘেঁষা এই জাম্বুর গ্রামের সিদ্দি মহল্লার চতুর্দিক এতটাই সুনসান যে রাতে কখনও কখনও সিংহের ডাকও ভেসে আসে।

Advertisement

দু’ধারে পাহাড় আর গভীর অরণ্যের নয়নশোভন, শাসন গির জেলা ছাড়িয়ে তালালার দিকে হাইওয়ে ঢুকতে ঢুকতে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে চারপাশ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে অলস আড্ডার মুখচ্ছবি। এই পাথরে খোদাই শরীর তো আবিসিনিয়ার!

এই রহস্যময় বদলের পিছনে রয়েছে কয়েকশো বছর ধরে বয়ে চলা জিন-পরম্পরার ইতিহাস। একটি বাইকে চলেছেন এমনই এক বলিষ্ঠ পুরুষ, পিছনে দু’টি বাচ্চাকে নিয়ে। তিন জনেরই পোশাকের রং উজ্জ্বল, পুরুষের চোখে হলুদ আভার সানগ্লাস। কোঁকড়ানো চুল, পুরু ঠোঁট। গলায় চেন।

Advertisement

আমার বাহন-চালক তাঁর বাইকের পাশে গাড়ি নিয়ে গিয়ে জানলা দিকে উঁকি মারলেন, “মোটা ভাই?” নিখুঁত গুজরাতিতে উত্তর এল “সু ছে?” সিদ্দি গাঁও জানতে চাওয়ায়, তিনি বললেন বাইকের পিছনে আসতে।

গির থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে গুজরাতের এই এক চিলতে আফ্রিকায় নিয়মমাফিক ভোট এসেছে। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার আগেই জানিয়েছিলেন, তিনি রাজ্যের প্রত্যন্ত প্রান্তের সিদ্দি সম্প্রদায়ের কাছে গণতন্ত্রের এই যজ্ঞকে পৌঁছে দেবেন। সেই অনুযায়ী এই এলাকায় তিনটি নির্বাচনী বুথ তৈরি হয়েছে কাল, বৃহস্পতিবার ভোটের জন্য। তফসিলি জনজাতি, মুসলিম সিদ্দিরা আদতে আফ্রিকার কোথা থেকে এসেছিলেন, ঠিক কোন দেশে তাঁদের জন্ম তা জানতে চাওয়ায় হেসে ফেললেন রবিস উদ্দিন। “আমার বাপদাদারাই জানে না, আমরা কী করে জানব। এই গ্রামমহল্লাই আমাদের দেশ। এই সরকারই আমাদের সরকার।” যে জনজাতি এতটাই উদাসীন (আপাত) তাঁদের মাতৃভূমি নিয়েই, সেই সমাজেই কিন্তু লাল কালিতে দাগিয়ে দেওয়া নিয়ম, গোষ্ঠীর বাইরের কাউকে বিয়ে করলে বহিষ্কৃত হতে হবে। ধরে রাখতে হবে রক্তের পরম্পরা। তাই এত শতক পরেও তাঁদের চেহারায় কোনও ভারতীয় মিশেল নেই।

কয়েকশো বছর আগে ক্রীতদাস প্রথার যখন তুমুল দাপট, ভারতে সমুদ্রপথে আনা হয়েছিল আফ্রিকার বেশ কিছু মানুষকে। তবে কারা এনেছিলেন, তা নিয়ে বহুমত। অনেকের মতে, পর্তুগিজরা আফ্রিকার মোম্বাসা, ইথিওপিয়া এবং সোয়েতো থেকে তাঁদের এনেছিলেন, আবার কারও মতে বহু আগে আরব থেকে তাঁরা এসেছিলেন। অনেকের তত্ত্ব, এঁদের পূর্বপুরুষরা হয় বান্টু (দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকার) নয়তো হাবসি (আবিসিনিয়া)। জুনাগড়ের নবাবের দেহরক্ষী হিসাবে এসে ক্রমশ বংশবিস্তার করে আজ তাঁরা সিদ্দি এবং সংলগ্ন আরও ষোলটি গ্রামে ছড়িয়ে গিয়েছেন। মোট ভোটার ষাট হাজার ছাড়িয়েছে। আফ্রিকার ভাষা তাঁরা জানেন না, কিন্তু সেই সুপ্রাচীন সংস্কৃতি বংশপরম্পরা সংরক্ষণ করে গিয়েছে আজও।

এই গ্রামের বাড়িগুলি মাটির। এই গ্রামের চুল্লি জ্বলে কেরোসিনে। এই গ্রাম প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা অথবা উজ্জ্বলার দেখা পায়নি। “কোনও নেতাই আমাদের জন্য ভাবেন না, তাই এ বার আমরা নিজেরাই দাঁড়িয়েছি”, বলছেন আব্দুল ইব্রাহিম ভাই। তিনি এ বার ভোটে লড়ছেন নির্দল প্রার্থী হিসাবে। “আমাদের জনজাতি সম্প্রদায় খেলাধুলোয় খুব ভাল। কবাডি আমরা দারুণ খেলি। সবার চেয়ে জোরে দৌড়তে পারি। শক্তি সামর্থ্যেও পিছিয়ে নেই। বহু শতাব্দী আগে কোথা থেকে পূর্বপুরুষরা এসেছিল সেই জাবর কেটে আর কী হবে, আমরা তো ভারতীয়। আরও বেশি করে আমাদের সেনায়, খেলাধুলোয় কেন ডাকে না রাজ্য? এ বার ভোটে গ্রামে গ্রামে ঘুরে সেটাই বলছি।” অন্য অনেক গ্রামের মতো তাঁদেরও অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী যোজনার অনেক বাড়ি শুরু হয়, তারপর আর এগোয় না। এ রকম অর্ধসমাপ্ত কিছু বাড়ি ঘুরিয়েও দেখালেন আব্দুল ইব্রাহিম।

গ্রামের একেবারে শেষে নাগারচি পীর বাবার দরগা। এখানকারই এক প্রাচীন সুফির নামাঙ্কিত দরগা। তাঁর জন্মদিন এই সিদ্দি এবং অন্য গ্রামের এই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত জনজাতিদের সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন। ওই সময় সারা রাত চলে নাচ গান। এবং সেই নাচ গরবা বা ডান্ডিয়া ঘরানার নয়। সিদ্দিদের লোকনৃত্য ধামাল। “বংশ পরম্পরায়. এই নাচ আমরা শিখেছি। শুনেছি আমাদের পূ্র্বপুরুষেরা এই নৃত্য করতেন। এখন আমরা টাকা নিয়ে গুজরাতের বিভিন্ন বিয়েশাদিতে নেচে আসি। ঢোলক নিয়ে যাই।”, বললেন বিলাল হুসেন। এটা তাঁদের পেশাও বটে। ভোট নিয়ে জানতে চাওয়ায় ইনি গোড়াতেই বলেছিলেন, “গুজরাতের ধরনটাই হল যে সরকারে আছে তাকে খুব একটা বদলাতে চান না কেউই। সরকারের পক্ষেই ভোট বেশি পড়ে।”

এই প্রান্তিক জনজাতিদের প্রতি কোনও রাজনৈতিক দলেরই বিরাট প্রেম থাকার যে কারণ নেই, তা সিদ্দিরা ভাল করেই বোঝেন। তাই মূল পেশা স্থানীয় মজদুরি সেরে নাগারচি পীর বাবার দরগার পাশে বসে ছিলিম টানেন শান্তিতে। হাতে পয়সা এলে দাবিয়ে খান মাছ আর মোর্গা।

এ বারে নির্দল হয়ে যিনি লড়ছেন, সেই আব্দুল ইব্রাহিম ভাইকে নিয়েও বিজেপি-র মাথাব্যথা নেই। আসলে গুজরাতের বান্টু কুলোদ্ভবরা লড়ছেন সরকারের নীতি বদলে দেওয়ার জন্য, এমন তো নয়। নিজেদের গোষ্ঠী পরিচয়কে এই রাজ্যে আরও প্রাসঙ্গিক রাখার জন্য তাঁদের রোজের লড়াইয়েরই এ এক অংশমাত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement