বলিউড সিনেমার কপূর বংশ তাদের শিকড় কলকাতার সঙ্গে ছিন্ন করে মুম্বইতে পাকাপাকি ভাবে প্রোথিত করলেও শশী কপূরের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাংলা এবং কলকাতা ফিরে এসেছে একাধিক বার। বলবীর রাজ পৃথ্বীরাজ কপূরের জন্ম কলকাতা শহরে। নাটক দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু চার বছর বয়েসে পৃথ্বীরাজ কপূরের হাত ধরে। তারপর মুম্বই শহরে এসে মাতুঙ্গার ডনবস্ক স্কুলে পড়াশুনো। রাজ কপূরের ছায়ায় চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ। শশীরাজ কপূর নামে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ। চলচ্চিত্রে অভিনয় জীবন শুরু করেন বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে রাজ কপূরের ছেলেবেলার ভূমিকায় অভিনয় করে। আগ, আওয়ারা ছবিতে রাজ কপূরের ছেলেবেলার ভূমিকায় অভিনয় করেন শশীরাজ। এরপর তাকে অশোক কুমারের ছেলেবেলার ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা যায়। নাট্য জগতের সঙ্গে যোগসূত্র তার ছিন্ন হয়নি। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অভিনয় সিনেমা এবং নাটক দুটো মাধ্যমেই চলতে শুরু করে। তিনি মনে করতেন যে অভিনয় এমন একটা কলা যা তিনি জানেন।
কলকাতা শহরেই তার প্রথম সাক্ষাৎ জেনিফার কেন্ডেলের সঙ্গে। জেনিফার তার বাবা জিওফ্রে কেন্ডেলের নাট্য গোষ্ঠী শেক্সপিয়েরনা’র অভিনেত্রী ছিলেন। জিওফ্রে তার নাট্য গোষ্ঠী নিয়ে কলকাতায় আসেন এবং পৃথ্বীরাজ কপূর তার নাট্য গোষ্ঠী নিয়ে কলকাতায় শো করতে যান। পৃথ্বীরাজ কপূরের নাট্যগোষ্ঠীর তিনি ছিলেন সহকারী মঞ্চ ব্যবস্থাপক এবং অভিনেতা। জেনিফার আর শশী কপূরের জন্য কলকাতা রঁদেভু হয়ে দাড়ায়। পরিচয় হয় শশী ও জেনিফারের। শশী কপূরের সঙ্গে জেনিফারের বিবাহে আপত্তি ছিল পরিবারের। কিন্তু শশী কপূরের দাদা শাম্মী কপূরের তদানীন্তন স্ত্রী গীতা বালি এই সম্পর্ক সমর্থন করে বিবাহটিকে বাস্তবায়িত করেন।
প্রথম দিকে বাণিজ্যিক হিন্দি ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করার কাজ পাচ্ছিলেন না শশী কপূর। সুপুরুষ, সংস্কৃতিবান চকোলেট হিরো হিসাবে তার অভিনয় প্রতিভাকে ভুল মূল্যায়ন করে নার্গিস, মধুবালা, মীনাকুমারীর মত নায়িকার বিপরীতে নিতে অনেকে সংশয় বোধ করতেন। ষাটের দশকে যশ চোপড়া নির্দেশিত ধর্মপুত্র নামের হিন্দি ছবিতে প্রথম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। দেশ ভাগ ও হিন্দু মৌলবাদ আধারিত ছবি ধর্মপুত্র তাকে রাতারাতি চিত্র তারকা বানিয়ে দেয়। সে সময়ের সফল অভিনেত্রী নন্দা অন্য নায়ক যাদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন তাদের তুলনায় শশী কপূরের মধ্যে ভিন্ন সংস্কৃতির ছোঁয়া দেখলেন। ষাটের দশকের প্রায় পুরোটাই নন্দার সঙ্গে জুটি বেঁধে শশী কপূর চার দিওয়ারি, মেহেন্দি রঙ্গ লায়েগি, মহব্বত ইসকো কহেতে হ্যায়, জব জব ফুল খিলে, নিন্দ হমারি খোয়াব তুমহারা, জুয়াড়ি, রাজা সাব এবং রুঠা না করো ইত্যাদি ছবি করেন। এরপর বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির সাফল্য তার সিনেমা জগতে এবং নাট্য জগতের বিশেষ অবদানকে আড়াল করে দেয়। এরপর তাকে হিন্দি মূল ধারার একশোটারও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। যার অর্ধেক ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় তিনি অভিনয় করেন। বাঙালি অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত ওয়াক্ত, আমনে সামনে, সুহানা সফর, আ গলে লগ জা, পাপ আউর পুণ্য ইত্যাদি অনেকগুলো জনপ্রিয় ছবি উপহার দেন। আ গলে লগ জা ছিল সময়ের থেকে এগিয়ে যাওয়া ছবি। চলচিত্র সমালোচকরা শর্মিলার ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেন। কিন্তু দর্শকরা ছবিটিকে গ্রহণ করেন। সমালোচকরা দুজনের অভিনয় প্রতিভার প্রশংসা না করে পারেন না। আর এক বাঙালি অভিনেত্রী রাখীর সঙ্গে ছবি করার আগে মনে করা হত রাখী-শশী জুটি মানাবে না। কিন্তু মুখার্জীদের শর্মিলি নামক ছবিটি সব ধারণাকে পাল্টে দিল। বাঙালি নায়িকার সঙ্গে তৈরি হল আর একটা ব্লক বাস্টার ছবি। একই ভাবে কভি কভি হয়ে যাওয়ার এত দিন বাদেও দর্শক শশী এবং রাখীর চরিত্র দুটিকে মনে রাখেন একটি নিখুঁত চরিত্রায়ন হিসাবে। এই সময় রাখী শশী কপূর জুটির অনেকগুলো ছবি হয় যেমন জানওয়ার আউর ইনসান, কভি কভি, বসেরা, পিঘলতা আসমান, তৃষ্ণা, দুসরা আদমি, বন্ধন কাচ্চে ধাগো কা এবং জমিন আসমান— যা সমালোচকদের প্রশংসা পেয়ে ছিল।
অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে সহ অভিনেতা হিসাবে অনেকগুলো ছবি করেন। তার মধ্যে প্রত্যেকটাই মনে রাখার মত। শশী কপূর সম্পর্কে অমিতাভ বচ্চন বলেন সহ অভিনেতা হিসাবে কাজ করার সময়ে কখনও বিরক্ত হতেন না তাই বোধহয় তিনি এতগুলো ছবি পরপর শশী কপূরের সঙ্গে করতে পেরেছেন। তার উৎসাহ ও অনুসন্ধিৎসা তার নিজের কাজকে ঘিরেই থাকত। সাত আট বছরের বড় শশী কপূর কয়েকটি ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের ছোট ভাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। সেলিম-জাভেদের লেখা দিওয়ার ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের সাথে শশী কপূরের সংলাপ ‘মেরে পাস মা হ্যায়’ এখনও মানুষ মনে রাখে। অমিতাভ বচ্চনের সাথে বারোটা ছবি তিনি করেছেন। রোটি কাপড়া আউর মকান, দিওয়ার, কভি কভি, ইমান ধরম, ত্রিশূল, কালা পাথ্থর, সুহাগ, দো আউর দো পাঁচ, শান, সিলসিলা, নমক হলাল, আকেলা প্রত্যেকটি ছবিই জনপ্রিয় হয়। এর মধ্যে যশ চোপড়ার সিলসিলাতে দুই ভাইয়ের অভিনয় বিশেষ ভাবে মনে রাখার মত।
মূল ধারার বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির জন্য গাছের তলায় নেচে গান গেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি বাস্তবমুখী অভিনয়ের দিকে ঝুঁকে পড়তেন। সংযোগ হয় আন্তর্জাতিক চিত্র পরিচালক ইসমাইল মার্চেন্ট ও জেমস আইভরির সঙ্গে। ষাটের দশক থেকে সত্তরের দশকের মধ্যে মার্চেন্ট আইভরি প্রোডাকশন্সের অনেকগুলো ছবি করেন। দ্য হাউসহোল্ডার, শেক্সপিয়ারওয়ালা, বম্বে টকি, হিট এন্ড ডাস্ট, দ্যা ডিসিভার, সাইড স্ট্রিট ছবির মধ্য বম্বে টকি’তে তার বিপরীতে অভিনয় করেন আর এক বাঙালি অভিনেত্রী অপর্ণা সেন এবং হিট এন্ড ডাস্টএ অভিনয় করেন জেনিফার কপূর। তিনি বহু ইংলিশ এবং আমেরিকান ছবিতে অভিনয় করেন। প্রেটি পলিতে হেলে মিলস্ এর বিপরীতে অভিনয় করেন। আন্তর্জাতিক ছবি সিদ্ধার্থতেও অভিনয় করেন। আন্তর্জাতিক ছবি মুহাফিজ’এ আরও একবার ইসমাইল মার্চেন্টের নির্দেশনায় কাজ করেন। জেনিফারের বাবা নাট্যকার জিওফ্রে মনে করতেন শশী কপূরের অভিনয় প্রতিভা সঠিক ভাবে ব্যবহার করা হয়নি। শেক্সপিয়রওয়ালা ছবির অভিনয় সম্পর্কে জিওফ্রে তার এক কন্যা ফেলিসিটি যিনি এই ছবিতে শশী কপূরের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন, একটা চিঠি লেখেন এবং তাতে বলেন ফেলিসিটির অভিনয় খুব ভাল হয়েছে। কিন্তু শশী কপূরের চরিত্রটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে একটি দৃশ্য ছাড়া। শশী কপূরের উচিত ইংলিশ নির্দেশকের অধীনে কাজ করা। গাই গ্রিণ, কনরাড রকস নামের দুই চিত্র পরিচালক তাকে কাজে নেন।
সত্তর দশকের শেষ দিকে মুম্বইতে শশী কপূর এবং জেনিফার কপূর পৃথ্বী নামে একটা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। পৃথ্বী থিয়েটারটা এখন যেখানে অবস্থিত সেখানে আগে একটা এক খণ্ড জমি পড়েছিল। শশী কপূর এবং জেনিফার কপূর দুজনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেন স্থাপত্যকার। শশী এবং জেনিফার কপূর দুজনে মিলে স্থাপত্যকারকে নির্দেশ দিতেন এই থিয়েটারটা কেমন হবে এবং কোথায় দর্শক আসন নির্দিষ্ট হবে।
রাজ কপূরের মতই মূল ধারার বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির থেকে বেরিয়ে অন্য ধরনের ছবিকে প্রশ্রয় দিয়ে উপার্জিত সঞ্চয় নষ্ট করার সাহস দেখান। অন্য ধরনের ছবি করবার আশা নিয়ে ১৯৭৮ সালে শশী কপূর ফিল্মওয়ালা নামে প্রোডাকশন হাউস তৈরি করেন। যেখান থেকে জুনুন, কলিযুগ, ৩৬ চৌরঙ্গী লেন, বিজয়েতা, উৎসব-এর ছবি মত বের হয়— যে ছবিগুলো হয়তো বক্স অফিসে বাজিমাত করতে পারেনি কিন্তু অন্য ধরনের ছবির মধ্যে প্রথম সারিতে উঠে এসেছে। উপার্জনের সব টাকাই প্রায় যেত পৃথ্বী থিয়েটার এবং ফিল্ম প্রোডাকশনস হাউস ফিল্মওয়ালার পিছনে। এই প্রোডাকশনের অন্যতম ছবি অজুবাতে নির্দেশনার কাজ করেন যেখানে অমিতাভ বচ্চন ও তার ভাইপো ঋষি কপূর মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন। এ ছবিটিও বিশেষ চলেনি। শশী কপূরই প্রথম অপর্ণা সেনকে চিত্র পরিচালকের স্বীকৃতি দেন। অপর্ণা সেনের নির্দেশনায় ৩৬ চৌরঙ্গী লেনে শশী কপূরের কলকাতা এবং বাঙালিদের সাথে আরও একবার সংযোগ ঘটে। শশী কপূরের স্ত্রী জেনিফার কপূর অভিনয় করেন এই ছবিটিতে। বাঙলার সঙ্গে সম্পর্ক তার এখানেই শেষ নয়। অভিনয় করেন তিনি গোয়েন্দা ফেলুদার ভূমিকায় সন্দীপ রায়ের দূরদর্শনের ধারাবাহিক যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে-র হিন্দি সংস্করণ কিসসা কাঠমান্ডু কা-তে। কিন্তু মোটা হয়ে যাওয়ায় তাকে ফেলুদার চরিত্রে একটু বেমানানই লেগেছিল।
জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তিন বার। জুনুন, নিউ দিল্লি টাইমস্, এবং মুহাফিজ-এ। নিউ দিল্লি টাইমস-এর গল্প লেখেন গুলজার আর তার বিপরীতে অভিনয় করেন অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর। তার প্রথম দিককার ছবি ধর্মপুত্র-এ অভিনয় করার জন্য জাতীয় পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তিনি মনে করেন ধর্মপুত্রে তার অভিনয় যথাযথ হয়নি— তাই জীবনের প্রথম জাতীয় পুরস্কার তিনি ফিরিয়ে দেন।
কিছু কিছু মানুষের কর্ম জীবনের সাফল্য তার ব্যক্তিগত জীবনকে জানতে উৎসাহিত করে। সিনেমা জগতের মানুষদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানার উৎসাহ বোধহয় সব থেকে বেশি দেখা যায়। আর সেই চিত্র তারকার ভক্তদের আগ্রহকে পুঁজি করে শুরু হয়ে যায় পাপারাৎজি। শুরু হয় অলীক বা অতিরঞ্জিত গল্প বা গুজব। বম্বে ফিল্ম জগতের কপূর পরিবারের প্রায় কেউই বাদ পড়েননি এই আধা-সত্যি ব্যক্তিগত চরিত্র বিশ্লেষণ থেকে। রাজ কপূর থেকে শুরু করে আজকের রণবীর কপূর পর্যন্ত সকলেই তাদের ব্যক্তিগত চরিত্রের জন্য আলোচিত এবং সমালোচিত হয়েছেন বহু বার। কপূর পরিবারের মেয়ে করিশ্মা কপূর এবং করিনা কপূরও একাধিক বার গুজবের মধ্যমণি হয়েছেন। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের রটনা এবং আধা ঘটনার শিকার এক বারও যারা হননি তারা হলেন পৃথ্বীরাজ কপূর এবং শশী কপূর। এর মধ্যে প্রথম জনের সমসাময়িক সংবাদ মাধ্যম এই ধরনের খবর প্রকাশ করায় বিশেষ পটু ছিল না। তাহলে রাজ কপূরের পরবর্তী সময়ের শশী কপূর কি তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না? তাই রটনা ও আধা ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি?
শর্মিলা ঠাকুর, রাখী ছাড়া আশা পারেখ, জিনাত আমন, হেমা মালিনীর সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু কখনও কোন অভিনেত্রীর সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে যায়নি। শশী কপূর কপূর পরিবারের এক নজির বিহীন ব্যক্তিত্ব যার জীবনের কোন ঘটনাকে রটনা তৈরি করা যায়নি এবং রটনাকে ঘটনা তৈরি করা যায়নি। আপাদমস্তক ভদ্রলোক এই কপূরের জীবনের পুরোটাই বাস্তব। পরিবারের অমতে বিবাহ করেছেন তিনি। জেনিফারের পরিবারেও আপত্তি ছিল। বাড়ির অমতে সব কিছু ছেড়ে এমনকী, বাবার নাটক কোম্পানি ছেড়ে এসে শশী কপূরের সঙ্গে সংসার পেতে ফেলেন জেনিফার। জেনিফারের কর্কট রোগ এবং সেই কারণে তার মৃত্যু শশী কপূর মেনে নিতে পারেননি। আর সেই কারণেই বহির্মুখী অনেক কাজই তিনি কমিয়ে দিয়েছিলেন। শশী-জেনিফারের পৃথ্বী থিয়েটার এখন তাদের ছেলে মেয়েরাই দেখাশোনা করে। কখনও কখনও তিনি আসেন বিকেলের দিকে পৃথ্বী থিয়েটারে। তার ছেলে কুণাল কপূর তার সম্পর্কে বলেন, ‘‘খুব কম লোকই প্রকৃত ভালবাসা পায়। আর যাঁরা তা পায় তাঁরা তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না।’’