রেললাইনে পড়ে দেহ। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডলয়।
একটা রাত কতটা অন্ধকার হতে পারে, বাহানাগায় না পৌঁছলে জানাই যেত না। জানা হত না, সেই রাত একই সঙ্গে হতে পারে কতটা মর্মান্তিক!
রেললাইন জুড়ে ওল্টানো একের পর এক ট্রেনের কামরা। চারপাশে ছড়িয়ে রক্তমাখা সব দেহ। দেহাংশও। শুক্রবার রাত তখন ১২টা। বাহানাগা রেলগেটের দিকে এগোচ্ছি। অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে— রাস্তার পাশেই রাখা সার সার মৃতদেহ। পুরীর রাজ্যে যেন মৃত্যুপুরী!
দুর্ঘটনাস্থল বাহানাগা থেকে বালেশ্বরের দূরত্ব প্রায় ১৬ কিলোমিটার। স্টেশন আর রেলগেটের মাঝে ঘটেছে দুর্ঘটনা। তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে করমণ্ডল আর যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের কামরাগুলো। করমণ্ডলের এস-১ কামরার উপরে উঠে গিয়েছে এস-২ কামরা। দেশলাইয়ের বাক্সের মতো উল্টে যাওয়া কামরা থেকে তখনও ঝুলছে যাত্রীদের হাত-পা। চারদিকে আর্তনাদ আর অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেনের শব্দ। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া কামরা থেকে যাত্রীদের উদ্ধারের কাজ চলছে। এসেছে এনডিআরএফ।
স্থানীয়েরা জানালেন, শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। বিকট শব্দ। বুঝতে পারেন, বড় কিছু হয়েছে। তাঁরা ঘটনাস্থলে এসে দেখেন, তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে ট্রেনের কামরাগুলো। মালগাড়ির বগির উপরে উঠে গিয়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন। যেটুকু জানা যাচ্ছে তাতে, পাশের লাইনের যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের একাধিক বগি লাইনচ্যুত হয়েছিল। সেগুলো করমণ্ডলের লাইনে চলে এসেছিল। লাইনচ্যুত যশবন্তপুরের কামরায় গিয়ে সজোরে ধাক্কা মারে করমণ্ডলের ইঞ্জিন। তার জেরেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতি।
রাতে যা আবছা বোঝা যাচ্ছিল, শনিবার দিনের আলো ফুটতে তা আরও স্পষ্ট হতে শুরু করে। বোঝা যায়, রাতে যা ভাবা হয়েছে, দুর্ঘটনার ভয়াবহতা তার থেকে অনেক বেশি। উদ্ধার কাজে সকালেই পৌঁছয় বায়ুসেনার একটি দল। সোরো হাসপাতাল থেকে বালেশ্বর জেলা হাসপাতাল, জখমদের আর্তনাদ আর পরিজনদের হাহাকার। যাঁদের পরিবারে খবর পৌঁছেছে, তাঁরা ছুটে ছুটে আসছেন।
বালেশ্বর হাসপাতালে রূপা হেমব্রম নামে তারকেশ্বরের এক তরুণী ছুটে এসেছেন স্বামী গোপালের খোঁজে। তিনি চেন্নাইয়ে কাঠের কাজ করতে যাচ্ছিলেন। ছিলেন করমণ্ডলের এস-১ কামরায়। দুর্ঘটনার পর থেকে গোপালের মোবাইল বন্ধ। আর ওই কামরার উপরেই উঠে গিয়েছে এস-২ কামরা। হন্যে হয়েও স্বামীর খোঁজ না পেয়ে রূপা বলছিলেন, ‘‘সব হাসপাতাল ঘুরেছি। কোথাও তো মানুষটা নেই! কী যে হয়ে গেল।’’সোরো হাসপাতালে দেখা মিলল পূর্ব মেদিনীপুরের মেচেদার দীপক মাইতির। তিনি স্ত্রী নমিতা মাইতিকে নিয়ে কটক থেকে যশবন্তপুর এক্সপ্রেসে ফিরছিলেন। সংরক্ষিত আসন নাপেয়ে উঠেছিলেন শেষের প্রতিবন্ধী কামরায়। দু’জনই জখম হয়েছেন। দীপক বলছেন, ‘‘স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম। আমাদের কামরাটা তো তিন বার পাল্টি খেয়েছে। কী করে যেন বেঁচে গেলাম!’’
রাত থেকেই গ্যাস কাটার দিয়ে ট্রেনের ওল্টানো, মোচড়ানো কামরাগুলো কাটার কাজ শুরু হয়। এডিআরএফের ডেপুটি কমান্ডান্ট ধনঞ্জয় কুমার বলছিলেন, ‘‘কামরার ভেতরে কেউ আটকে থাকতে পারতেন। তাই ধীরে ধীরে কামরা কাটা হয়েছে।’’ ঘটনাস্থলে এসেছিলেন ওড়িশার দমকলের ডিজিসুধাংশু সারেঙ্গী।
শুক্রবার গভীর রাতেও এক-একটা দেহ উদ্ধার হচ্ছিল। চাদরে মুড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল রাস্তার পাশে। সেখানেই রাখা হচ্ছিল। পরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালের মর্গে, ময়নাতদন্তের জন্য। রাত গড়িয়ে সকাল। তার পরে আবার একটা রাত। তখনও সমানে চলেছে উদ্ধারকাজ।
কোথায় গিয়ে থামবে মৃত্যু মিছিল, কারও জানা নেই।