জম্মু কাশ্মীর পুলিশের সাসপেন্ডেড ডিএসপি দেবেন্দ্র সিংহের নাম এখন জাতীয় সংবাদমাধ্যমে বহুলচর্চিত। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, দেবেন্দ্র যে হিজবুল জঙ্গিদের নিরাপদে জম্মুতে নামিয়ে আনছিলেন তারা পাক-অধিকৃত কাশ্মীর ও পাকিস্তানে হওয়া দু’টি অভিযানের প্রতিশোধ নিতে দিল্লি, পঞ্জাব অথবা চণ্ডীগড়ে বড় মাপের বিস্ফোরণের ছক কষেছিল। দেবেন্দ্র সিংহের মামলা হাতে নিয়েছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। ২০১৮ লোকসভা ভোটের ঠিক আগে পুলওয়ামায় আধাসেনার কনভয়ে বিস্ফোরণের সময়ে সেখানে দেবেন্দ্রের উপস্থিতি নিয়ে তরজায় জড়িয়েছে কংগ্রেস ও বিজেপি। আসুন একবার উঁকি দেওয়া যাক দেবেন্দ্রর অতীত-জীবনে।
পুলওয়ামা জেলার ত্রালের বাসিন্দা দেবেন্দ্র শ্রীনগরের অমর সিংহ কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। ১৯৯৪ সালে তিনি জম্মু কাশ্মীর পুলিশে যোগ দেন এস আই পদে। পরে স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ বা এসওজি-র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হন।
তোলাবাজি এবং দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল এসওজি থেকে। কিছুদিন সাসপেন্ডেড থাকার পরে তাঁকে পাঠানো হয় শ্রীনগর পুলিশ কন্ট্রোল রুম বা পিসিআর-এ। এরপর পদোন্নতিও হয়। ২০০৬ সালে তিনি পুলিশের ডেপুটি সুপার হন। তার আট বছর পরে তিনি স্থানান্তরিত হন ট্রাফিক পুলিশে।
গত বছর দেবেন্দ্র কর্মরত ছিলেন শ্রীনগর বিমানবন্দরের অ্যান্টি হাইজ্যাকিং ইউনিটে। কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর পদোন্নতির কথা ছিল। সে ক্ষেত্রে পুলিশ সুপার পদে উন্নীত হতেন তিনি।
দেবেন্দ্র সিংহের পাওয়া পদক নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। জম্মু কাশ্মীর পুলিশ টুইট করে জানিয়েছে, দেবেন্দ্রকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে কোনও সাহসিকতার পদক দেওয়া হয়নি। ২০১৮-র স্বাধীনতা দিবসে তিনি জম্মু কাশ্মীরের পুলিশের একজন কর্মী হিসেবে সাহসিকতার পদক পেয়েছিলেন।
এর আগে আফজল গুরুর মুখে দেবেন্দ্র সিংহের বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা গিয়েছে। সংসদ হামলাকাণ্ডের মূল চক্রী আফজলকে ফাঁসি দেওয়া হয় তিহাড় জেলে, ২০১৩-র ৯ ফেব্রুয়ারি।
২০১৩ সালেই লেখা আফজলের একটি চিঠিতে দেবেন্দ্রর উল্লেখ ছিল। সেখানে আফজল বলেছিলেন, দেবেন্দ্র তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন জনৈক মহম্মদ নামে এক ব্যক্তির। সংসদ হানায় আর এক অভিযুক্ত ওই মহম্মদকে নাকি নিরাপদে দিল্লিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আফজল গুরুকে বলেছিলেন দেবেন্দ্র।
সেখানেই শেষ নয়। ‘ছোট্ট কাজ’-এর মধ্যে ছিল মহম্মদকে দিল্লিতে একটা ভাড়ার থাকার জায়গা যোগাড় করে দেওয়া। এমনকি, একটি গাড়ি কিনে দেওয়াও। দাবি আফজলের। পাশাপাশি, মোটা অঙ্কের টাকা চেয়েও তাঁর উপর দেবেন্দ্র অকথ্য অত্যাচার করেছিলেন বলে অভিযোগ ছিল আফজলের।
ওয়েবসাইট স্ক্রোল ডট ইন-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি, ২০০৬-এই দেবেন্দ্র সাংবাদিক পারভেজ বুখারির কাছে স্বীকার করেছিলেন, তিনি আফজল গুরুর উপরে নির্যাতন চালিয়েছিলেন। (প্রতীকী চিত্র)
তদন্তে জানা গিয়েছে দেবেন্দ্র গত ১১ জানুয়ারি তাঁর ডিউটিতে অনুপস্থিত ছিলেন। ছুটি চেয়েছিলেন রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার অবধি। অর্থাৎ ১২ থেকে ১৬ জানুয়ারি অবধি। কিন্তু তার আগেই ধরা পড়ে গেলেন তিনি। হিজবুল কম্যান্ডার এবং প্রাক্তন পুলিশকর্মী নভিদ বাবার সঙ্গে তাঁর কথোপকথন ধরা পড়ে যায় গোয়েন্দাদের কাছে।
টেলিফোনের ওই কথাবার্তা গোয়েন্দাদের গোচরে আসতেই পাতা হয় ফাঁদ। অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি ইন্সপেক্টর অতুল গয়াল। তিনি নিজে নজরদারিতে ছিলেন চেকপয়েন্টে। শনিবার কুলগামের কাছে একটি গাড়ি থেকে ধরা পড়েন অভিযুক্ত দেবেন্দ্র সিংহ এবং দু’জন হিজবুল জঙ্গি।
গোয়েন্দাদের কাছে দেবেন্দ্রর যুক্তি ছিল তিনি জঙ্গিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন তাদের বড় কোনও নেতাকে জালে ধরবেন বলে। কিন্তু তাঁর দাবি ধোপে টেকেনি। প্রোটোকল অমান্য করার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় রিভলভার ও একে ৪৭ রাইফেল। (প্রতীকী চিত্র)
কয়েক সপ্তাহ ধরেই পুলিশের নজরে ছিলেন দেবেন্দ্র। শোপিয়ানের পুলিশ সুপার সন্দীপ চৌধুরীর অধীনে থাকা দল প্রথম টেলিফোনে কথোপকথনের উপর নজর রাখে। গোয়েন্দাদের দাবি, দেবেন্দ্র পরিকল্পনা করেছিলেন হিজবুল জঙ্গিদের কাশ্মীর থেকে পাকিস্তানে পাঠানোর। তার জন্য নাকি তাঁকে ১২ লাখ টাকা দেওয়াও হয়েছিল! দেবেন্দ্রর জম্মু এবং ত্রালের বাড়িতেও নাকি বিভিন্ন সময়ে গিয়েছে জঙ্গিরা।
আইজিপি কাশ্মীর বিজয়কুমার জানিয়েছেন, দেবেন্দ্র সিংহ এর আগে জঙ্গিদমন অভিযানে অংশ নিয়েছেন। তারপরেও ঘৃণ্য অপরাধ করেছেন। তাঁকে জেরা করা হচ্ছে। আনল’ফুল অ্যাক্টিভিটিজ অ্যাক্ট এবং অস্ত্র আইনে তদন্ত চলছে। (ছবি: আর্কাইভ, সোশ্যাল মিডিয়া, আই স্টক)