গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বঘেলের বিরুদ্ধে ‘মহাদেব বেটিং অ্যাপ’ দুর্নীতির অভিযোগ আর ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ নিয়ে যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ কংগ্রেস এবং বিজেপির লড়াই। শুক্রবার দ্বিতীয় তথা চূড়ান্ত দফার ভোটের আগে মূলত এই জোড়া বিষয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে ছত্তীসগঢ়। গত পাঁচ বছরের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ, না কি তার আগের ১৫ বছরের রমন সিংহ, শেষ পর্যন্ত রায়পুরের কুর্সিতে কে বসবেন, তা জানা যাবে আগামী ৩ ডিসেম্বর।
ছত্তীসগঢ় বিধানসভায় মোট ৯০টি আসন। তার মধ্যে মাওবাদী-উপদ্রুত ২০টি আসনে গত ৭ নভেম্বর প্রথম দফা ভোট নেওয়া হয়ে গিয়েছে। বাকি ৭০টি আসনে ভোটগ্রহণ শুক্রবার। ভোট হবে রায়পুর, বিলাসপুর, ভিলাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে। দ্বিতীয় দফায় নির্ধারিত হবে ৯৫৮ জন প্রার্থীর ভাগ্য। শাসক দল কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন ভূপেশ বঘেল (পাটন), উপমুখ্যমন্ত্রী ত্রিভুবনেশ্বর শরণ সিংহদেও (অম্বিকাপুর), বিধানসভার স্পিকার তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চরণদাস মহন্ত (শক্তি)।
গ্রাফিক: শৌভিক ঘোষ।
বিজেপির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের কেন্দ্রে ভোট প্রথম দফায় হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় দফার লড়াইয়ে রয়েছেন কেন্দ্রীয় আদিবাসী উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী রেনুকা সিংহ (ভরতপুর-সোনাহাট) এবং বিলাসপুরের সাংসদ তথা রাজ্য বিজেপি সভাপতি অরুণ সাউ (লোরমি)। মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রার্থী তাঁরই ভাইপো তথা সাংসদ বিজয় বঘেল।
২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটে দেড় দশকের বিজেপি শাসনের ইতি ঘটিয়ে প্রথম বার বিধানসভা ভোটে জিতে ছত্তীসগঢ়ে ক্ষমতা দখল করেছিল কংগ্রেস। রাজ্যের ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৬৮টি জিতেছিল তারা। বিজেপি মাত্র ১৫টি। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজিত জোগীর হাতে গড়া দল ‘জনতা কংগ্রেস ছত্তীসগঢ়’ (জেসিসি) পাঁচটি এবং তার সহযোগী বিএসপি দু’টি বিধানসভা আসনে জয়ী হয়েছিল। কংগ্রেস ৪৩ এবং বিজেপি ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। শুক্রবার দ্বিতীয় দফায় যে ৭০টি আসনে ভোট হতে চলেছে, গত বার তার মধ্যে ৫১টিতেই জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস। বিজেপি ১৩, জেসিসি ৪ এবং বিএসপি ২টি আসনে জিতেছিল।
৯০ আসনের ছত্তীসগঢ় বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জাদুসংখ্যা ৪৬। এবিপি-সি ভোটার জনমত সমীক্ষার সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী কংগ্রেস ৫১, বিজেপি ৪৫ এবং অন্যেরা ২টি আসনে জিততে পারে। বাস্তবের সঙ্গে জনমত সমীক্ষা বা বুথফেরত সমীক্ষা মেলে না অনেক সময়েই। তবে মিলে যাওয়ার উদাহরণও কম নয়। ভোটপ্রচারের প্রথম পর্যায়ে জনমত সীমাক্ষায় কংগ্রেস অনেকটা এগিয়ে থাকলেও পরের ধাপে ব্যবধান অনেকটাই কমে এসেছে। ফলে রাজ্য ক্ষমতা বদলের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছেন ভোট পণ্ডিতদের একাংশ। তাঁদের মতে, শেষবেলায় মূলত দু’টি বিষয় রাহুল গান্ধী-মল্লিকার্জুন খড়্গের দলের বিপক্ষে গিয়ে থাকতে পারে। প্রথমত, মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশের বিরুদ্ধে ‘মহাদেব বেটিং অ্যাপ’ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ। দ্বিতীয়, প্রভাবশালী দলিত জনগোষ্ঠী সতনামী সমাজের অবিসংবাদিত নেতা গুরু বালদাসের বিজেপিকে সমর্থন।
গত ৩ নভেম্বর ইডি-র তরফে দাবি করা হয়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভিলাই থেকে অসীম দাস নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে তারা। কেন্দ্রীয় সংস্থাটির অভিযোগ, কংগ্রেসের নির্বাচনের খরচ জোগাতে ওই ব্যক্তিকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে পাঠিয়েছিলেন ‘মহাদেব’ অ্যাপের মালিকেরা। ইডি-র দাবি, ‘বঘেল’ নামে এক রাজনীতিককে দেওয়ার জন্য অসীম ৫.৩৯ কোটি টাকা নিয়ে এসেছিলেন দুবাইয়ে আশ্রয় নেওয়া ‘মহাদেব অ্যাপ’-এর মালিকের কাছ থেকে। এর পরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভোটপ্রচারে ছত্তীসগঢ়ে গিয়ে নিশানা করেন বঘেলকে।
পরবর্তী সময়ে ‘মহাদেব বেটিং অ্যাপ’-এর মালিক শুভম সোনি সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে একটি ভিডিয়ো বার্তায় (যার সত্যতা আনন্দবাজার অনলাইন যাচাই করেনি) বঘেলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কথা স্বীকার করেন। ফলে সুর চড়েছে বিজেপির। ভোটের বাজারে ‘মহাদেব’ তাই কংগ্রেসের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। যদিও বঘেল সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সেই সঙ্গে বিধানসভা ভোটের আগে কংগ্রেস শাসিত ছত্তীসগঢ় এবং রাজস্থানে কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি-র ‘অতি সক্রিয়তা’ নিয়ে মোদী সরকারকে বিঁধেছেন তিনি।
এক সময় সামাজিক ভাবে অস্পৃশ্য দলিতদের নিয়েই সতনামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রয়াত গুরু ঘাসীদাস। সেই সতনামী সমাজের হাতে এখন রাজ্যের ১৬ শতাংশ ভোট। অন্তত এক ডজন আসনে সতনামী ভোটাররাই নির্ণায়ক শক্তি। ২০১৮ সালে সেই সমাজের নেতা প্রকাশ্যে কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিলেন। যা রমন সরকারের পতনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়ে। এ বার সতনামী গুরু সমর্থন করেছেন পদ্মকে। ‘জনতা কংগ্রেস ছত্তীসগঢ়’-এর পাশাপাশি প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রভাবশালী আদিবাসী নেতা অরবিন্দ নেতমের নতুন দল ‘হামার রাজ পার্টি’ এবং মূলত আদিবাসী খ্রিস্টানদের সংগঠন ‘সর্ব আদি দল’ও কংগ্রেসের ভোটে কিছুটা ভাগ বসিয়ে বিজেপির সুবিধা করে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে বিজেপির মোকাবিলায় দেদার জনমোহিনী সরকারি প্রকল্প এবং অঙ্গীকারের কথা শোনা যাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী বঘেলের মুখে। কৃষিঋণ মকুব, ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, ধানের দাম কুইন্টাল প্রতি ৩২০০ টাকা করা, একর প্রতি ২০ কুইন্টাল ধান কেনা, গ্যাসের সিলিন্ডারে ৫০০ টাকা ভর্তুকির মতো ‘জনমুখী প্রতিশ্রুতি’ রয়েছে এই তালিকায়।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পের অনুকরণে মহিলাদের মাসে ১৫ হাজার টাকা আর্থিক অনুদানের কথাও ঘোষণা করেছেন বঘেল। একদা মোদীর কটাক্ষের শিকার ‘রেউড়ি (খররাতি) রাজনীতি’ অনুসরণে পিছিয়ে নেই বিজেপিও। দেড় দশক রায়পুরের কুর্সিতে কাটানো রমনের প্রতিশ্রুতি, চতুর্থবার মুখ্যমন্ত্রী হলে মহিলাদের মাসে হাজার টাকা দেবেন তিনি। তবে দেড় দশক মুখ্যমন্ত্রী পদে থেকে বিজেপি নেতা রমন গ্রাম-গরিবের মন জয়ে ২ টাকা কেজি দরে ৩৫ কিলোগ্রাম করে চাল বিলি করে ‘চাউলওয়ালে বাবা’ হয়ে উঠেছিলেন। মুফতে স্মার্টফোনও বিলি করেছিলেন। কিন্তু চাষির ঋণ মকুব করতে পারেননি। যা পেরেছেন ভূপেশ। প্রচারে সে কথাও কংগ্রেস মনে করিয়ে দিচ্ছে বৈকি!