এ কথা বলতেই হবে, ইউক্রেনে ভারতীয় দূতাবাসের ন্যূনতম সহযোগিতা আমরা পাইনি। নিজেরাই সাহস করে বেরিয়ে এসেছি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে আটকে পরা নিজের নাগরিককে ফেরাতে এমন অব্যবস্থা কেন? উত্তর কেউ খুঁজবেন না। তাই ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে। এমন অব্যবস্থার মধ্যেও মনে রাখার মতো রোমানীয় ভালবাসা বুকে নিয়ে বিহারের সিওয়ানে ফিরব। আজীবন সঙ্গে থাকবে।
রোমানিয়ার শিবিরে ভারতীয় দূতাবাস কর্মীরা। ছবি: লেখক
এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, অনেকটা যুদ্ধ জিতে ফেলেছি। আর একটু। যদিও সেই ক্লাইম্যাক্সের প্রতীক্ষায় গত পাঁচ ঘণ্টা ধরে বসে আছি রোমানিয়ার স্ত্রাদা অরিজন্তুলুই-এর শরণার্থী শিবিরে। এখান থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরত্বে বিমানবন্দরে পৌঁছতে ১২-১৩ ঘণ্টা লাগবে। গত কয়েক দিন ধরে পেরিয়ে আসা পথ ভাবলে শিহরণ হয়।
যুদ্ধ ঘোষণা হতেই পরদিন নিজের অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বন্ধুর কাছে গিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু সেখানে ইতিমধ্যেই আরও দু’জন পৌঁছে গিয়েছিল। তাই অন্য বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টে যাই। খানিকটা জোর করেই ২৬ তারিখ সীমান্ত পারাপারের জন্য বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সাহায্যে এগিয়ে আসেন এক ইউক্রেনীয় প্রতিবেশী। তাঁর নিজের গাড়িতে করে নিপার নদীর সেতুর আগে ছেড়ে দিলেন। কারণ, সেতুটি একমুখী। নয়তো তাঁর ফিরে আসতে সমস্যা হবে। এর পরে আট কিলোমিটার হেঁটে কিভের ভোকজ়ালনা রেল স্টেশনে পৌঁছই। পথে মাঝে মাঝে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী আর ট্যাঙ্ক চোখে পড়ছিল।
ভোকজ়ালনা থেকে অনেক কষ্টে ট্রেনে উঠলাম। টাকা লাগেনি। অনেক বাচ্চার জুতো, বড়দের ব্যাগ ট্রেনে ওঠার তাড়াহুড়োয় পড়ে গেল স্টেশনে। এখন ভাবলে মনে হয়, কোনও সিনেমা কি দেখলাম! আট ঘণ্টার ট্রেনের পথ ষোলো ঘণ্টা পার করে রাত দুটোর সময়ে ইভানো শহরে পৌঁছলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার স্টেশন। তখন জরুরি অবস্থা চলছে। কোনও ক্যাব পেলাম না। পাঁচ কিলোমিটার পথ অন্ধকারে হেঁটে ইভানো মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলে পৌঁছলাম। যে কোনও কারণেই হোক ঢুকতে পারলাম না। কিভের এক বন্ধু সাহায্য করেন। তাঁর পরিচিত বন্ধু এসে যখন নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে গেলেন, তখন ভোর চারটে। পেটে আগুন জ্বলছে। সামান্য কিছু খেয়ে নিই।
সকাল ন’টায় ইভানো হস্টেল থেকে বাস ছাড়ল। ১৭০০ ভারতীয় টাকায় সেই বাসে চেপে ইউক্রেনের সীমান্তে পৌঁছলাম। বাস ছেড়ে দিল দশ কিলোমিটার আগে। সেই পথ হেঁটে পৌঁছলাম সীমান্তের কাছে। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। শুনলাম, বেশির ভাগই সেখানে গত চার-পাঁচ দিন ধরে অপেক্ষা করছেন। কোনও মতে চালাকি করে আগের লাইনে ঢুকে গেলাম আমরা তিন জন। সেখানেও আরেক দৃশ্য। বাচ্চারা ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে, বড়রা উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন। সাঙ্ঘাতিক পরিবেশ। এর মধ্যেই শূন্যে গুলি চালাতে থাকে ইউক্রেনীয় বাহিনী। এতে শিশুরা আরও ভয়ে কুঁকড়ে গেল।
প্রায় তিন-চার ঘণ্টা অপেক্ষা করে অবশেষে পেরোলাম ইউক্রেন সীমান্ত। হাতে ট্রানজ়িট ভিসা নিয়ে যখন রোমানিয়া পৌঁছলাম। তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল।
এখানে আমাদের খাওয়াদাওয়া, থাকার ব্যবস্থায় পুরো নজর রাখা হয়েছে। ঠান্ডার উপযুক্ত জ্যাকেট, কম্বল, জুতো, মোজা দেওয়া হয়েছে। রাতে তাপমাত্রা নেমেছিল মাইনাস ৩ ডিগ্রিতে। বরফ পড়ায় তাঁবুতে কষ্ট হচ্ছিল। অনেকে সে-টুকুও পাননি। শেষে আমাদের সবার জন্য বাসের ব্যবস্থা করে নিয়ে আসা হয় আয়তনে বড় এই শিবিরে। অসুস্থ পড়ুয়াদের আগে ফেরানোর ব্যাপারে এখানে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাই আমাদের প্রতীক্ষা একটু দীর্ঘ হচ্ছে।
এ কথা বলতেই হবে, ইউক্রেনে ভারতীয় দূতাবাসের ন্যূনতম সহযোগিতা আমরা পাইনি। নিজেরাই সাহস করে বেরিয়ে এসেছি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে আটকে পরা নিজের নাগরিককে ফেরাতে এমন অব্যবস্থা কেন? উত্তর কেউ খুঁজবেন না। তাই ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে। এমন অব্যবস্থার মধ্যেও মনে রাখার মতো রোমানীয় ভালবাসা বুকে নিয়ে বিহারের সিওয়ানে ফিরব। আজীবন সঙ্গে থাকবে।
লেখক ডাক্তারি পড়ুয়া
অনুলিখন: জয়তী রাহা