ইলাহাবাদ হাইকোর্ট।
দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে কে কোন ধর্মের তা নিয়ে কোনও ব্যক্তি, পরিবার, এমনকি রাষ্ট্রও হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বিজেপিশাসিত বেশ কয়েকটি রাজ্যে যখন ‘লাভ জেহাদ’-এর বিরুদ্ধে আইন আনা হচ্ছে, তখনই এই রায় দিল ইলাহাবাদ হাইকোর্ট। ভিন্ন ধর্মে বিয়ে নিয়ে একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারপতিরা সোমবার সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘‘আমরা প্রিয়ঙ্কা খাড়ওয়াড় ও সালামত আনসারিকে হিন্দু-মুসলিম হিসেবে দেখছি না। তাঁরা দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, যাঁরা এক বছর ধরে নিজেদের ইচ্ছায় শান্তিপূর্ণ ভাবে একসঙ্গে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন। ফলে আদালত তাঁদের জীবন ও সংবিধানের ২১ ধারায় প্রাপ্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করছে।’’
পূর্ব উত্তরপ্রদেশের কুশীনগরের বাসিন্দা সালামত গত বছরের অগস্টে প্রিয়ঙ্কাকে বিয়ে করেন। বিয়ের ঠিক আগে প্রিয়ঙ্কা ধর্ম পরিবর্তন করে নিজের নাম রাখেন আলিয়া। বিয়েতে আপত্তি ছিল প্রিয়ঙ্কার পরিবারের। সেই মাসেই প্রিয়ঙ্কার পরিবারের তরফে সালামতের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়। বিয়ের জন্য অপহরণের অভিযোগ আনা হয়।
দাবি করা হয়, বিয়ের সময়ে প্রিয়ঙ্কা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন— তাই পকসো-য় অভিযোগ আনা হয়েছিল। তবে বিয়ের সময়ে প্রিয়ঙ্কা যে প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন, সে কথা প্রমাণ হতেই ইলাহাবাদ হাইকোর্ট ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়টিকে সামনে এনে রায় শুনিয়েছে।
আরও পড়ুন: কাবুলকে বার্তা দিল্লির
বিচারপতি বিবেক আগরওয়াল ও বিচারপতি পঙ্কজ নকভির বেঞ্চের রায়ে বলা হয়েছে, ‘‘দেশের আইন দু’জন মানুষকে (তাঁরা সমলিঙ্গের হলেও) শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করার অধিকার দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তাঁদের নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী একে অন্যের সঙ্গে থাকতেই পারেন। কোনও ব্যক্তি, পরিবার এমনকি রাষ্ট্রও তাতে বাধা দিতে পারে না।’’ বিচারপতিরা বলেছেন, ‘‘কে কার সঙ্গে থাকবেন, সেটা তাঁর নিজের ব্যাপার। এর সঙ্গে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। ফলে সঙ্গী নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করলে নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়।’’
‘লাভ জেহাদ’-এর ধুয়ো তুলে হইচইয়ের এই আবহে ইলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় শুনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন শর্মিলা ঠাকুর। মনসুর আলি খান পটৌডীকে যিনি জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, সেই শর্মিলাকে ‘লাভ জেহাদ’ কটাক্ষ শুনতে হয়েছিল করিনা কপূরের সঙ্গে পুত্র সইফ আলি খানের বিয়ের সময়ে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গে জুড়ে থাকা সংগঠন দুর্গা বাহিনীর আক্রমণের নিশানায় ছিলেন সইফ-করিনাও। শর্মিলা আজ আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘খুবই ভাল রায়। ইলাহাবাদ হাইকোর্ট একের পর এক দারুণ সব রায় শোনাচ্ছে। রায়কে স্বাগত জানাচ্ছি।’’
নবদম্পতি আদালতে জানিয়েছিলেন, তাঁদের বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্যই যাবতীয় অভিযোগ আনা হয়েছে। জবাবে প্রিয়ঙ্কার পরিবার ও যোগী আদিত্যনাথের সরকারের তরফে বলা হয়, বিয়ের জন্য ধর্ম পরিবর্তন নিষিদ্ধ। ফলে এ বিয়ের আইনি ভিত্তি নেই। তবে হাইকোর্ট এই বিয়েকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি এই বিষয় নিয়ে ইলাহাবাদ হাইকোর্টেরই অন্য বিচারপতিদের দেওয়া অতীতের দু’টি রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে দুই বিচারপতির বেঞ্চ। ২০১৪ সালে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করা পাঁচ দম্পতি আদালতের কাছে নিরাপত্তার আর্জি জানিয়েছিলেন। সেই আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছিল। আর গত সেপ্টেম্বর মাসে এমনই এক দম্পতি বিয়ের পরে তিন মাসের জন্য তাঁদের নিরাপত্তা চেয়ে আর্জি জানান। সেই মামলায় হাইকোর্টের বিচারপতি শীর্ষ আদালতের রায়ের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘‘বিয়ের জন্য ধর্ম পরিবর্তন কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’’ তবে ওই দু’টি রায়ের প্রসঙ্গে এ বার বিচারপতিরা বলেছেন, ‘‘দু’টি ক্ষেত্রেই দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতার দিকে নজর দেওয়া হয়নি। এতে আইনের উপযুক্ত প্রয়োগ হয়নি।’’
আরও পড়ুন: সন্ত্রাসে পাক মদত দিয়ে প্রচার শুরু নয়াদিল্লির
ইলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় এমন সময়ে এসেছে যখন ‘লাভ জেহাদ’-এর বিষয় নিয়ে দেশের রাজনীতি সরগরম। তথাকথিত ‘লাভ জেহাদ’ রুখতে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ আজ রাতে অর্ডিন্যান্স অনুমোদন করেছে। মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক, হরিয়ানার মতো রাজ্যগুলিও নতুন আইন এনেছে বা তা আনার পথে চলেছে। কয়েক সপ্তাহ আগে যোগী আদিত্যনাথ যোগী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘পরিচয় লুকিয়ে যারা আমাদের বোনেদের সম্মান নিয়ে খেলা করছে, তাদের আমি সতর্ক করে দিচ্ছি। তোমরা যদি নিজেদের পথ থেকে সরে না দাঁড়াও, তা হলে কিন্তু রাম নাম সত্য হ্যায়-এর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।’’