গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপের বাজারে ‘রিমুভ চায়না অ্যাপস্’-এর কদর এখন সবচেয়ে বেশি। আত্মপ্রকাশের সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই ৫০ লক্ষের বেশি বার অ্যাপটি ডাউনলোড হয়েছে। গুগ্লের অ্যাপ-বাজার ‘প্লে স্টোর’-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় ফ্রি অ্যাপগুলির তালিকায় ওই অ্যাপ এখন এক নম্বরে। ট্রেন্ডিং অ্যাপগুলির তালিকাতে দ্বিতীয় স্থানে।
কিন্তু এমন কী আছে এই অ্যাপে যে, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এটি ডাউনলোড করছেন?
করোনাভাইরাসের উৎসস্থল হিসেবে চিন নিয়ে একটা চাপা আতঙ্ক ছিলই। তারই মধ্যে লাদাখে চিনা সেনার আগ্রাসন। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় যুদ্ধের মেঘ জমতেই ভারতে নতুন প্লাবন শুরু হয়েছে #BoycottChina। আর এমন সময়েই বাজারে এই অ্যাপের আবির্ভাব, গত ১৭ মে। মোবাইলে বেশি জায়গা নেয় না এই অ্যাপ, ফাইল সাইজ মাত্র ৩.৮ এমবি। ব্যবহার করাও সহজ। একগুচ্ছ অনুমতি প্রদান বা লগ-ইনের প্রয়োজন নেই। স্রেফ ‘স্ক্যান নাও’ বাটনে ট্যাপ করলেই বেরিয়ে আসছে ফোনে থাকা কিছু চিনা অ্যাপের তালিকা, সেই সঙ্গে আনইনস্টল করার অপশন। যাতে ক্লিক করলেই কাজ শেষ। ফোন থেকে ‘ছুড়ে’ ফেলা যাবে ওই চিনা অ্যাপগুলি।
সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই ৫০ লক্ষের বেশি বার অ্যাপটি ডাউনলোড হয়েছে।
‘মেড ইন চায়না’ শুনে একটা কিন্তু কিন্তু ভাব থাকলেও নানা সামগ্রীর সঙ্গে ভারতের মোবাইল ফোন ও অ্যাপের বাজারে চিনেরই রমরমা। বিশ্বের অগ্রণী মার্কেট রিসার্চ ফার্ম আইডিসি-র হিসাব বলছে ভারতের স্মার্টফোনের বাজারের ৬৭ শতাংশই চিনা ফোন নির্মাতাদের দখলে। ফ্যাক্টর ডেইলি-র হিসেবে ভারতে ব্যবহৃত প্রথম ১০০টা অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপের মধ্যে ৪৪টাই চিনা। এমন পরিস্থিতিতে ‘রিমুভ চায়না অ্যাপস্’-এর সাহায্যে চিনা অ্যাপ সরিয়ে ফেলছেন অনেকেই। প্লে স্টোরে তরতরিয়ে বেড়েছে এই অ্যাপের রেটিং। প্রায় ২ লক্ষ মানুষের রেটিংয়ে ৫-এর মধ্যে এই অ্যাপের প্রাপ্ত নম্বর ৪.৯। ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে অস্ট্রেলিয়াতেও বাড়ছে এর জনপ্রিয়তা। সে দেশে প্রথম পাঁচটি অ্যান্ড্রয়েড টুলস্ অ্যাপের মধ্যে রয়েছে এটি।
আরও পড়ুন: পকেটের টাকায় বাস চালাতে পারব না, অনড়ই রইলেন মালিকরা
এই অ্যাপ কি আদৌ কার্যকরী?
অ্যাপটির নির্মাতা রাজস্থানের জয়পুরের সংস্থা ওয়ানটাচ অ্যাপল্যাবস্। সংস্থার ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে, এটি একটি ‘স্টার্টআপ’ সংস্থা। ওয়েবসাইট ও অ্যাপ তৈরির ৮ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু সংস্থার ওয়েবসাইট বা প্লে স্টোর ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, তাদের তৈরি করা একমাত্র সফটওয়্যার বা অ্যাপ বলতে আড়াই সপ্তাহ পুরনো এই ‘রিমুভ চায়না অ্যাপস্’। এটাই তাদের তৈরি প্রথম অ্যাপ। কেমন কাজ করে সেই অ্যাপ? রেডমি, রিয়েলমি-র বিভিন্ন চিনা ফোনেই এই অ্যাপটি ইনস্টল করে দেখে গিয়েছে যে, ফোনে থাকা কোনও চিনা অ্যাপ এটি সরাতে পারে না। টিকটক, ক্যামস্ক্যানার বা শেয়ারইট-এর মতো আলাদা করে ডাউনলোড করা জনপ্রিয় কিছু চিনা অ্যাপ খুঁজে বার করতে পারে। কিন্তু প্রথম থেকে ফোনে থাকা বা ‘প্রি-ইনস্টলড’ চিনা অ্যাপগুলিকে ধরতেই পারে না এই অ্যাপ।
সত্যিই কি অ্যাপ দেখে ধরা যায় তার নাম-গোত্র?
এ বিষয়ে সাইবার বিশেষজ্ঞ এবং এথিক্যাল হ্যাকার মহম্মদ রেজা আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘প্লে-স্টোরে যেটুকু পরিচয় দেওয়া থাকে, সম্বল বলতে ওইটুকুই। ও ভাবে অ্যাপ দেখে বোঝা যায় না তা কোন দেশে তৈরি। হতেই পারে, ভারতে তৈরি হওয়া কোনও সংস্থার অ্যাপ আপনি ব্যবহার করছেন। কিন্তু তা যে বকলমে চিনা কোনও সংস্থা চালাচ্ছে না, তা কে বলতে পারে? অসংখ্য চিনা অ্যাপ প্লে-স্টোরে ছড়িয়ে আছে। যাদের চিনতে গেলে চাই বিশাল ডেটাবেস। জয়পুরের সংস্থার তৈরি এই অ্যাপ শুধুমাত্র কিছু বহুল ব্যবহৃত অ্যাপকেই চিহ্নিত করতে পারছে, বাকিগুলোকে নয়। কারণ ওই গুটিকয়েক নামই এই অ্যাপের মগজে ঢোকানো আছে।’’
কী ভাবে চিনা অ্যাপ চিনতে পারছে ‘রিমুভ চায়না অ্যাপস্’, এ বিষয়ে জানতে আনন্দবাজার ডিজিটালের তরফে ই-মেল করা হয়েছিল ওই সংস্থাকে। কিন্তু এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত তার জবাব আসেনি।
আরও পড়ুন: নির্দেশ সত্ত্বেও সুনসান স্টুডিয়ো পাড়া, সুরক্ষাবিধি মেনে শুটিং শুরু হতে পারে সপ্তাহের শেষে
এই অ্যাপের মাধ্যমে কি বিপন্ন হতে পারে আপনার স্মার্টফোন?
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আবির আতর্থীর বলছেন, ‘‘গুগ্ল প্লে-স্টোরে এই অ্যাপ আছে মানে, এক দফা নিরাপত্তা পরীক্ষার পরেই অ্যাপটি সেখানে রাখা হয়েছে। কিন্তু এমন অনেক অ্যাপ আছে, যেগুলি প্রথমে নিরাপদ মনে হলেও পরে সেগুলো থেকেও ম্যালওয়্যার ধরা পড়েছে।’’ এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন জোকার ম্যালওয়্যারের কথা (ম্যালওয়ার বা ক্ষতিকারক সফটওয়্যার আপনার ফোন, ল্যাপটেপ থাকা গোপন তথ্য হাতিয়ে নিতে অদ্বিতীয়)। গুগ্লের নজর এড়িয়ে ৬০০টি অ্যাপে ঢুকে পড়েছিল এই ম্যালওয়্যার। যা ব্যবহারকারীর অজান্তেই তার জিও লোকেশন চিহ্নিত করে বিভিন্ন প্রিমিয়াম সার্ভিসে নথিভুক্ত করাচ্ছিল। অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে যাচ্ছিল টাকা। ম্যালওয়্যারটি নিজেই ওটিপি মেসেজ ডিলিট করে দিচ্ছিল। ফলে ইউজার ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছিলেন না তার চোখের আড়ালে কী ঘটে চলেছে।
মহম্মদ রেজা আহমেদ আরও একটা বিপদের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘এই অ্যাপের জনপ্রিয়তা দেখে কিছু দিনের মধ্যে প্লে-স্টোর ভরে যেতে পারে এমন অসংখ্য ক্লোন অ্যাপে। প্লে স্টোরে হোয়াটসঅ্যাপ লিখে দেখুন, একই রকম দেখতে অনেক অ্যাপ পাবেন। এই সব অ্যাপে থাকা ম্যালওয়্যার সহজেই আপনার পাসওয়ার্ড চুরি করতে পারে।’’ একান্তই এই অ্যাপ ব্যবহার করার ইচ্ছে হলে প্লে-স্টোর থেকে ডাউনলোড করে করুন।’’ কোনও থার্ড পার্টি ওয়েবসাইট বা কারও পাঠানো লিঙ্ক থেকে এই অ্যাপ ডাউনলোড করার ক্ষেত্রে তিনি সতর্ক করেছেন।
চিনা নয় এমন অ্যাপ মানেই ভাল?
সম্প্রতি লাদাখের শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী সোনম ওয়াংচুক ‘চায়না কো জবাব’ নামে ইউটিউবে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করে চিনা দ্রব্য ও সফটওয়্যার বয়কট করার ডাক দিয়েছেন। অভিনেতা মিলিন্দ সোমন সেই ডাকে সাড়া দিয়ে চিনা অ্যাপ টিকটকের ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন। তা হলে বহু ব্যবহৃত চিনা অ্যাপগুলির বিকল্প কী? এই প্রশ্নের পাল্লা ভারী হতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে একগুচ্ছ অ-চিনা অ্যাপের তালিকা। কিন্তু সেই সমস্ত অ্যাপের সব ক’টাই যে নিরাপদ তার কোনও গ্যারান্টি নেই বলেই মনে করেন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।