Independence Day

স্বাধীনতার মানে: বিজয়ী পাঠকদের লেখা

আপনার কাছে স্বাধীনতার মানে কী? ব্যক্তি আপনি বা নাগরিক আপনি কি আজও কোনও স্বাধীনতার প্রত্যাশী? মতামত দিয়ে লেখা পাঠিয়েছেন পাঠকরা। কেউ নিপাট গদ্যে। কেউ কবিতার ভাষায়। যাঁরা লেখা পাঠিয়েছেন সবাইকে ধন্যবাদ।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৭ ১৬:৫২
Share:

আপনার কাছে স্বাধীনতার মানে কী? ব্যক্তি আপনি বা নাগরিক আপনি কি আজও কোনও স্বাধীনতার প্রত্যাশী? মতামত দিয়ে লেখা পাঠিয়েছেন পাঠকরা। কেউ নিপাট গদ্যে। কেউ কবিতার ভাষায়। যাঁরা লেখা পাঠিয়েছেন সবাইকে ধন্যবাদ। পাঁচটি মনোনীত লেখা এখানে ছাপা হল। যাঁদের লেখা মনোনীত হল, তাঁদের অভিনন্দন।

Advertisement

স্বাধীনতার আশা

Advertisement

সৌম্য প্রতীক মুখোপাধ্যায়

সাতচল্লিশের সকালে আমরা স্বভাবতই উদীপ্ত ছিলাম। অনেক আশা নিয়ে যাত্রা শুরু।

সাতান্ন সালে আমাদের মনে শঙ্কার সিঁন্দুরে মেঘ উঁকিঝুকি দেওয়ার শুরু।

সাতষট্টি সন্ধিক্ষণে নতুন জমানার নতুন স্লোগানে খানিক চনমনে ভাব।

সাতাত্তর যেন কালবৈশাখীর রাত্রির পরের সকাল।

সাতাশির আকাশ কুয়াশা ঢাকা এক শীতের দিন, কুয়াশা যেন সকাল ছাড়িয়েও দুপুরে ।

সাতানব্বই অস্থির। কোনও কিছু করার জন্য। কিন্তু ঠিক কী করার জন্য, সেটা যেন জানা নেই।

সাত সালে সংখ্যাতত্ত্বের খেলাতে নাকি দেশ নাকি অনেক আগে এগিয়ে গিয়েছে বা যেতে চলেছে।

আর সতেরো সালে...?

স্বাধীনতার মানে খুঁজতে গেলে ভেসে আসে কিছু কোলাজ—

মারাঠা দেশের খরাজীর্ণ কৃষকের শূন্য দৃষ্টি।

শহরের রাস্তার পুলিশের তাড়া খেয়ে বেড়ান ফেরিওয়ালা।

বিনা চিকিৎসায় মৃত কোনও শিশুর মায়ের কান্না।

বছর তেইশের এক যুবকের অন্তহীন অপেক্ষা– একটি জীবিকা অর্জনের অবলম্বনের জন্য।

শীতল মনের একদল রাজনীতির খেলোয়াড়- যাদের মন যদি থাকে তাহলে সেটির সাথে কাজের কোনও মিল নাই।

কিছু প্রতিশ্রুতি– যা বলা হয়ই ভুলে যাবার জন্য।

কিছু মিথ্যাভাষণ- লোকজনকে খ্যাপানোর জন্য।

কিছু অধার্মিকের ধর্ম কথা– বিভাজন রেখা টানার জন্য।

স্বাধীনতা চাই আবার। সত্তর বছর পরে- ফের একবার- মুক্তির খোঁজে মানুষ।

*********************************************************

আমার স্বাধীনতা

প্রতিমা সরকার

স্বাধীনতা শব্দটির ব্যাপ্তি অনেক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কতটা স্বাধীন হতে পেরেছি মনে প্রাণে। স্বাধীনতা বলতে আমি শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা ভাবি না। আমি স্বাধীন দেশেই জন্মেছি। ব্রিটিশদের দ্বারা পরাধীনতার গ্লানি আমি ইতিহাসে পড়েছি কিন্তু তার পরেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যে প্রকৃত অর্থেই কি আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক ?

আমার কাছে স্বাধীনতা মানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত কাজ করতে পারা। চোখের সামনে একজন অসহায় মানুষ দেখলে তার দিকে সাহায্যের হাত কারও অনুমতি ছাড়াই বাড়িয়ে দিতে পারার মধ্যেও আমি স্বাধীনতা খুঁজে পাই। যেখানে বিকৃত মনস্ক মানুষ শিশু কিংবা নারীর ওপরে নির্যাতন চালায়, সেখানে স্বাধীনতা আমাকে প্রতিবাদ করতে শেখায়। সেই প্রতিবাদ কোনও রাজনৈতিক নেতা বা পাড়ার প্রভাবশালী দাদার ভয়ে ভীত না। আমার স্বাধীনতার অভিধান জাত-পাতের ভেদাভেদ থেকে মুক্ত। চিকিৎসার নামে কোন দুঃস্থ জনকে প্রবঞ্চনার শিকারও হতে হয় না।

জনগণের মঙ্গলের তোয়াক্কা না করে দেশের নেতা মন্ত্রীরা যখন যা খুশি নিয়ম আরোপ করলে আমার স্বাধীনতা খর্ব হয়। স্বাধীনতা মানে আমি বুঝি সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যাপ্তি। আমার স্বাধীনতা শিশু শ্রমিক চায় চায় না। কাদা মাটি মেখে যে শিশুটি মাঠে খেলছে তার মুখের হাসিতে আমি স্বাধীনতাকে দেখতে পাই।

*********************************************************

স্বাধীনতা তুমি

তুষার আহসান

স্বাধীনতা আমি তোমায় বুঝেছি রবি ঠাকুরের গানে

সবার উপরে তোমার পতাকা আমার হৃদয় মানে

স্বাধীনতা তুমি এখন আছ কি, দেখেছ কি কল্যাণ

মানুষের চেয়ে গরু বড় আজ, বিবেক হয়েছে ম্লান

ছাতির বহরে বাক্যবাহারে নিত্যনতুন নিদান

বিজয় মাল্য গলায় ঝুলল, এই তো দশের বিধান

ঋণ মকুবের খতিয়ানে যত আম্বানি, আদানি

গরিব চাষি গুলি খেয়ে মরে, পান খাওয়া পিকদানি

সুজলা সুফলা স্বাধীনতা তুমি ময়ূরের কান্নায়

গোবর এখন পরমাণুরোধী, ছাড় নাই রান্নায়

স্বাধীনতা তুমি সকলের আশা, অভয় বার্তাবাহী

তবে কেন পরীক্ষা, মানবতার ভিক্ষা, আর্তের ত্রাহি ত্রাহি?

*********************************************************

আমার কাছে স্বাধীনতার অর্থ্ হল সব অর্থে স্বাধীন

সেখ ইবাদুল ইসলাম

স্বাধীনতার ৭০ বছর পর স্বাধীনতা দিবসের দিনে আমরা কি হলফ করে বলতে পারব, দেশের সব মানুষ দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পাচ্ছে? সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে? ইংরেজরা এ দেশ থেকে চলে গিয়েছে ঠিকই, কিন্ত বঞ্চনা কি বন্ধ হযেছে? দেশের দুর্বলতর শ্রেণির অধিকারকে প্রতিষ্ঠা কী সম্ভব হয়েছে?

আসলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এসেছে ঠিকই, এখনও সামাজিক স্বাধীনতা আসেনি। আমাদের সংবিধান বাক স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্ত স্বাধীনতার ৭০ বছর পরও আমাদের দেশে সেই বাক স্বাধীনতা শাসকের ইচ্ছাধীনে পরিণত হয়েছে। এখনও কানহাইয়া কুমারের মত স্কলারকে নিজস্ব মতামত প্রদানের দায়ে জেল খাটতে হয়েছে। স্বাধীনতার ৭০ বছর পর এ দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। শিক্ষা থেকে শুরু করে সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের নীতি নয়, দলীয় আদর্শকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চলছে। শিক্ষা এখন জ্ঞানের বিষয় নয়, তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দলের আদর্শের শিক্ষা। এই স্বাধীনতা আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা চাননি। তাঁরা চেয়েছিলেন দেশের প্রতিটি নাগরিক জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সমনাধিকার দিতে। প্রতিটি নাগরিকের জন্য শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। প্রতিটি নাগরিকের প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলি যাতে পুরণ হয়, সেই ব্যবস্থা স্বাধীন দেশের সরকার করবে এটাই চেয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। রুটি-কাপড়া-মাকান এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা যাতে পূরণ হয় সেই লক্ষ্যেই স্বাধীনতা সংগ্রামীরা জীবনকে তুচ্ছ করে আত্ম-বলিদান করেছিলেন।

তাঁদের চাহিদা আর আত্ম-বলিদান যে সার্বিকভাবে সফল হয়নি তা কোনও দ্বিধা না রেখেই বলা যায়। আজকের দেশ পরিচালকরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামে শপথ করেও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা নিয়মে পর্যবসিত করেছেন। আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে মানুষের ভোটে ক্ষমতায় আসার পর সাধারণ মানুষের উপর আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দিয়ে দেশের উন্নয়নের কথা ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। দেশের সম্প্রীতিকে বিপন্ন করে সংখ্যালঘু সমাজকে আতঙ্কের মধ্যে রেখে দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে কেউ মন্তব্য করতে চাইলে তাঁর দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে তুমি মুসলমান পরিচয়ের বাইরে বের হয়ে, ভারতীয় হতে পারোনি!এখানে শেষ নয়, অস্পৃশ্যতাকে আমাদের দেশের সংবিধানে কড়াভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংবিধান ও আইনের চোখে সকল নাগরিকের সমান আধিকারের কথা সংবিধান বলেছে। স্বাধীনতার ৭০ বছর পর দলিত হওয়ার অপরাধে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পারছে অনেক সন্তান। সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে যোগ্যতা থাকা সত্তেও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার নজির ভুরিভুরি। এই স্বাধীনতা কি চেয়েছিলেন আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা!

*********************************************************

স্বাধীনতা!স্বাধীনতা!স্বাধীনতা!

অরিন্দম চৌধুরী

কার স্বাধীনতা? কীসের স্বাধীনতা? প্লিজ একটু বলবেন।

আরে মশাই পাগল নাকি? স্বাধীনতা মানে বোঝেন না, আমাদের দেশ স্বাধীন, আমরা যা কিছু করতে পারি। তাই নাকি? কিন্তু দেশপ্রেমিকরা বলেন স্বাধীনতা মানে অন্য কিছু বলতেন। স্বাধীনতা মানে অরাজকতা নয়। স্বাধীনতা মানে শুধু ১৫ই অগাস্ট নয়। স্বাধীনতা মানে দেশ প্রেম, দেশকে মা রূপে পরিগণিত করা- "আমার জননী আমার মা, আমার জননী আমার দেশ"। স্বাধীনতা মানে এক দিনের ছুটি নয়, নয় পতাকা উত্তলন, নয় ক্লাবে ক্লাবে উচ্চস্বরে মাইক বাজানো। এই মুহূর্তে স্বাধীনতার ৭০ বছর পেরিয়ে আমরা কি স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছি!

আত্মমর্যাদার জন্য যদি কাউকে আত্মহত্যা করতে হয়, নূন্যতম বেঁচে থাকার অধিকারটা যদি পাওয়া না যায়, অথবা প্রত্যেক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারটা যদি কারও দয়া দাক্ষিণ্যের উপরে নির্ভর করতে থাকে, তবে কি আমরা স্বাধীন? আমার দেশ কি স্বাধীন? অনেক দেশপ্রেমিক মনে করতেন- স্বাধীনতার পরেও কম পক্ষে পাঁচ বছর মিলিটারি শাসন দরকার। দেশের যুব সম্প্রদায়ের চরিত্র গঠন ও নিয়মানুবর্তিতা শেখার জন্যে।

স্বাধীনতার অর্থ- দেশকে একটি সুদৃঢ় ভিতের উপরে দাঁড় করানো; দেশের মানুষের নূন্যতম প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র ও বসবাস যোগ্য স্থানের চাহিদা পূরণে সক্ষম করে তোলার সাথে কর্মসংস্থান ও বিজ্ঞান বিষয়ক দিকে দেশকে স্বনির্ভর করে তোলা। স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণ করা, স্বাধীনতার অর্থ দেশের প্রতি আরও কর্তব্য পরায়ণ হওয়া।

স্বাধীনতার অর্থ এটা নয় যে মানুষের দ্বারা তৈরি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সিঁড়ি বানিয়ে ক্ষমতা দখল আর সিংহাসনে বসে তার অপব্যবহার করা। এই ক্ষমতা দখলের সিংহাসনটি হতে পারে গ্রামের সালিশি সভার প্রধানের সিংহাসন অথবা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের সিংহাসন অথবা কোনও রাজ্যের মন্ত্রিবর্গের সিংহাসন অথবা দেশের প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন। তাই স্বাধীন দেশের স্বাধীন জনগণের উচিত কোনও ব্যক্তিকে ক্ষমতা দখলের সিংহাসনে বসাবার আগে সেই ব্যক্তির ন্যূনতম অন্তর্নিহিত মূল্যবোধের ও তার শিক্ষার সঠিক মূল্যায়ন করে নেওয়া। নচেত্ স্বাধীনতার অপব্যবহার করার দায় শুধু সেই ব্যক্তি বিশেষের উপরে বর্তায় না, সাথে সাথে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের শিক্ষা, বুদ্ধি ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে একটি প্রশ্নচিহ্ন উঠে যায়। জনগণ যদি জ্ঞানত কোনও অসৎ ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসায় তাহলে অসৎ ব্যক্তি অপেক্ষা জনগণ বেশি দোষী।

দেশ উন্নত হচ্ছে- ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’- দামি দামি অস্ত্র কিনছি- পরমাণু সমৃদ্ধ আমার দেশ। কিন্তু আসল অস্ত্রটি সঠিক ভাবে বানানো গেল না। সমস্ত জনগণকে সঠিক শিক্ষা দেওয়া গেল না। দেশ যান্ত্রিক অস্ত্রে পরিপূর্ণ কিন্তু জনগণের অভ্যন্তরীন ‘অস্ত্র’ নেই। বিদেশি শক্তিকে আমাদের সাথে লড়াই করে জয় লাভ করতে হবে না। শুধু অশিক্ষার আগুনে বাতাস দিলেই দেশ জ্বলে ছারখার হয়ে যাবে। কোনও অস্ত্রই কাজে আসবে না। অশিক্ষার কারণে আরও বেশি করে জন্ম নেবে দেশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের চাহিদা, যা মেটাতে প্রচুর দাম দিয়ে কেনা অস্ত্র বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার আগেই দেশের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি, ইংরেজরা যে শুধু অনেক অনেক অস্ত্র নিয়ে ভারতমাতাকে পরাধীন করে রেখেছিল তা কিন্তু নয়। ওরা ওদের শিক্ষা নিয়ে এল, আর যাওয়ার সময় স্বাধীন করে দেওয়ার নাম করে একটি দেশকে দুই ভাগ করে গেল। সাথে সাথে সারা জীবন একটি ক্রেতা নিশ্চিত করল যে কিনা অস্ত্র কিনেই যাবে শুধু নিজের দেশের মধ্যে গজিয়ে ওঠা বিচ্ছিন্নতাবাদকে মেটাবার জন্যে। স্বাধীনতার সঠিক অর্থ একমাত্র হতে পারে দেশের জনগণের ন্যূনতম সঠিক শিক্ষাদানের অঙ্গীকারে ব্রত হাওয়া। শিক্ষাই পারে সব পরাধীনতার থেকে মুক্ত করতে। অন্ধকারে আলো জ্বালাতে। দেশের জনগণের শিক্ষা বিনা, সমস্ত স্বাধীনতাই পরাধীনতার শিখলে বাঁধা।

আমার দেশ স্বাধীন- কোনও হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করতে পারার অধিকারের স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি। তাতে কোনও সমস্যা নেই, হয়ত বা ৬০ কি ৭০ জন মানুষই বা মারা গেছে, ১৩০ কোটি জনসংখ্যাতে কোনও প্রভাব পড়বে না, দু’দিনের মধ্যে দরিদ্র সাধারণ মানুষ সব ভুলে যাবে, তারা কোনও দিনও জানল না যে সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারটা একটি স্বাধীনতা।

দেশের বড় বড় মন্ত্রী মশাইরা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড অট্টালিকা বানাচ্ছেন যার নাম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। তা দিয়ে নাকি স্বাস্থ্য খাতে রেনেসাঁ জন্ম নেবে, তবে দুঃখের বিষয় হল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ভিতরে রুগীদের করুণ আর্তনাদ শুনলে বোঝা যায় যে কি বিপুল আকারে জনগণের সাথে প্রতারণা চলছে। এক দল ক্ষমতাশীল মানুষ সাধারণ জনগণের অর্থ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার জন্যে দেশের চরম ক্ষতি করে যাচ্ছে শুধু সাধারণ মানুষকে সামনে রেখে। দেশের মধ্যে চিকিৎসা শাস্ত্রের জন্য ভাল কোনও বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে না, সব ব্যক্তিতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিগণিত হচ্ছে, অর্থের বিনিময়ে শংসাপত্র বিক্রি হচ্ছে, আর যারা তা কিনছে তারা সেই অর্থ নিজেদের গৃহে পুণরায় গচ্ছিত করার জন্যে সাধারণ মানুষের যে কোনও রকমের ক্ষতি করতে দ্বিধা করে না। ৭১তম স্বাধীনতা দিবসে দাঁড়িয়েও সাধারণ মানুষ প্রতি দিন সহ্য করে নিচ্ছে অশিক্ষার চাবুকের ঘা। তারা আজও জেনে উঠতে পারল না যে স্বাস্থ্য পরিষেবা একটি মৌলিক অধিকার।

আমরা স্বাধীন- দেশের মধ্যে এখনও প্রতি দিন প্রকৃত কৃষককে আত্মহত্যা করতে হয়। ফসলের বীজ কেনার অর্থ নেই। ঋণের অর্থ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যাকে মুক্তির সহজ উপায় বলে ভেবে নিচ্ছে প্রকৃত কৃষকেরা। "কৃষক সারা জীবন চাষ করে আর সারা জীবন ধরে ঋণের সুদের অর্থ শোধ করে"- সব চাইতে দুঃখের বিষয় হল প্রকৃত কৃষকদের সামনে রেখে কিছু সুযোগ সন্ধানী মানুষ আমাদের স্বাধীন দেশের স্বাধীন সরকারের কাছ থেকে স্বাধীনভাবে ঋণের টাকা তুলে নিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তি নেই এই স্বাধীন দেশের স্বাধীন সরকারের কাছে। সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করা দরকার কৃষকদের আর্থসামাজিক জীবনযাত্রা নিয়ে, কৃষকদের প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক ভাবে কৃষি উন্নয়নের প্রশিক্ষণ। সঠিক কৃষককে সঠিক ভাবে চিহ্নিতকরণ প্রয়োজন, সাথে সাথে দরকার শিক্ষা। শিক্ষিত কৃষক পারে নিজের অধিকারটি বুঝে নিতে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফসলের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে। ৭১ তম স্বাধীনতা দিবসে দাঁড়িয়ে আমাদের উচিত দেশের নাগরিকদের জন্য নূন্যতম খাদ্যের সুনিশ্চিত বন্দোবস্ত করা, যাতে কি না কোনও কৃষকে অনাহারে আত্মহত্যা করতে না হয়।

বর্তমানে আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো অভিবাসন বা মাইগ্রেশন। আমরা যদি সঠিক রাজনৈতিক পদক্ষেপ না নিতে পারি বা সবকটি রাজনৈতিক দলগুলিকে অথবা দলের নেতা মন্ত্রীদের ন্যূনতম শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারি যে ‘দেশের জন্যে রাজনীতি, রাজনীতির জন্যে দেশ নয়’- তা হলে মাইগ্রেশন কোনও দিন বন্ধ করা যাবে না। ভারতবর্ষের সীমানা সংলগ্ন রাজ্যগুলিতে দৃষ্টি দিলে দেখা যাচ্ছে যে কী বিপুল পরিমাণে মাইগ্রেশন চলছে সমস্ত স্বাধীন প্রশাসনের চোখের সামনে দিয়ে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের সিংহাসনটি মজবুত করার জন্য তা বিনা বাধায় মেনে নিচ্ছে।

বর্তমানে রাজনৈতিক নেতাদের ন্যূনতম শিক্ষার প্রয়োজন সব থেকে বেশি। তাঁদের জানা বা অনুভব করা উচিত যে "দেশের ঊর্ধে রাজনীতি নয়, রাজনীতির ঊর্ধে দেশ"। নির্বাচন যায়, আবার ফিরে ফিরে আসে, কিন্তু যে মানুষটা একবার কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে ঢুকে পরে সে আর কোনও দিন ফিরে যায় না। দেশের প্রতি তার কতটা দায়িত্ববোধ জন্মায় সেটা বোঝার অনেক অনেক আগে দেশের নাগরিকত্ব প্রমাণের দায়িত্ব তারা পূর্ণ করে ফেলে। স্বাধীন দেশ, সেও স্বাধীন, দেশের স্বাধীন নাগরিক, তাকে কিছু বলা যাবে না। তাদের সাথে কোনও না কোনও রাজনৈতিক দল আছে যাদের একটাই স্লোগান- "তোমরা আমাদের ভোট দাও আমি তোমাদের সমস্ত কিছু করার স্বাধীনতা দেব। ৭১তম স্বাধীনতা দিবসে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রথম উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিশুদ্ধকরণের সাথে সাথে দেশের প্রতি একটা দায়িত্ববোধের কথা সর্বদা মনে করিয়ে দেওয়া।

আমরা স্বাধীন - মঙ্গলে উপগ্রহ পাঠাচ্ছি। বিশ্বে আমরা উন্নত হিসাবে পরিগণিত হব। তবে ঠিক নির্বাচনের সময় আজও এক্সিট পোল বিচার করা হচ্ছে "যাদব কটা ভোট দেবে, দলিত কটা ভোট দেবে, মুসলিম কটা ভোট দেবে, ব্রাহ্মন কটা ভোট দেবে"। নিজেকে লজ্জিত মনে করি, উপগ্রহ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় কবি কেন লিখলেন "জাতের নাম বজ্জাতি সব"! এই দেশে আজও নেতা ঠিক করা হয় দলিত দেখে, মুসলিম দেখে, হিন্দু দেখে। হায়রে মানুষ তোর তো কোনও পরিচয়ই নেই, মানুষের থেকে তো গরু ভাল, তাকেও রক্ষা করতে একদল আছে, তোর কে আছে? তুই মানুষ পরে আগে মুসলিম অথবা হিন্দু, আবার হিন্দু হলেই হবে না দলিত হতে হবে অথবা যাদব হতে হবে।

৭১ তম স্বাধীনতা দিবসে দাঁড়িয়ে আমরা নেতা নির্বাচন করি তার জাত দেখে, তার শিক্ষা দেখে নয়। আমরা উন্নত দেশ। এগোচ্ছি! বর্তমানে একটি নতুন রাজনীতির ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে সেটা আরও বিপজ্জনক- সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরু। কিছু রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুকে বিশেষ ভাবে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করছে, আবার কিছু দল সংখ্যাগুরুকে বিশেষ ভাবে পাইয়ে দেবার রাজনীতি করছে। ফলে জাতপাতের রাজনীতিটা চরম আকার ধারণ করছে। এই বিশেষ ভাবে পাইয়ে দেবার রাজনীতি ইংরেজের সময়কালেও দেখা গিয়েছে। তা হলে আমরা কোথায় স্বাধীনতা অর্জন করলাম।

৭১তম স্বাধীনতা দিবসে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবা উচিত- দেশের উন্নতি তখনই সম্ভব যদি সঠিক নেতৃত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। আমাদের সবার উচিত দেশের স্বার্থে ও নিজেদের স্বার্থে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকা। সবাই যদি চিন্তা করি রাজনীতি খারাপ, তার ফল স্বরূপ দেশের সমস্ত নাগরিকও খারাপ থাকতে বাধ্য। দেশের নাগরিকরা ছাড়া দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। নিজেদের স্বার্থে দেশের স্বার্থে ভাল নেতার দরকার। ব্যক্তিত্ব বিনা ভাল নেতৃত্বের জন্ম হয় না। পচা পাঁকে বাস করে পঙ্কজ সর্বদা হওয়া যায় না। তাই প্রথমে উচিত পচা পাঁক সরিয়ে ভাল সরোবর তৈরি করা তাতে নিশ্চিত পদ্ম ফুটবে। তেমনি দেশের শিক্ষিত নাগরিক সমাজের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিশুদ্ধকরণ করা। নচেৎ দেশের ও দশের উন্নতি সম্ভব নয়। রাজনীতির বাইরে কিছু হয় না, মহাভারত হতে বাইবেল, কোরান, সর্বত্রই শুদ্ধ রাজনীতির ছাপ পরিষ্কার দেখা যায়। কোনও মানুষই রাজনীতির ঊর্ধে নয়, রাজনীতি দেশের ঊর্ধে নয়। দেশ রাজনীতি বিনা নয়। অতএব সব উন্নতির, সব স্বাধীনতার, সব রাজনীতির সঠিক নেতৃত্বের দরকার, সঠিক প্রজার দরকার, শিক্ষার দরকার, ভক্তির দরকার, ত্যাগের দরকার, আদর্শের দরকার, দায়িত্ববোধের দরকার, মানুষের দরকার। মানুষ চাই, মান আর হুঁস দুটি যার আছে "মানুষ" যে জানে "আমি আত্মা! আমি ভগবান! আমি অশেষ! আমি অজয়! আমি সে! আমি সে! আমি সে! "

(উপরের সবকটি লেখার মতামত লেখকের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত )

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement