গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
হতে পারে এ নিছকই এক ঘটনাচক্র। কিন্তু ১৩ মে, শুক্রবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা জয়ের একাদশ বর্ষপূর্তির ঠিক আগের দিন তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প ন্যানো নিয়ে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করলেন রতন টাটা। কেন তিনি ন্যানো গাড়ি তৈরির কথা ভেবেছিলেন, কী ছিল তাঁর পরিকল্পনা— বৃহস্পতিবার এ সবই তিনি লিখেছেন ওই পোস্টে। সেটি নেটমাধ্যমে ইতিমধ্যেই ভাইরাল। যেমন ভাইরাল ২০১১ সালের ১৩ মে মমতার মহাকরণের অলিন্দ থেকে লাখো জনতার দিকে হাত নাড়ার ছবি। যে ছবি টুইট করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতার সতীর্থেরা।
২৪ ঘণ্টার তফাতে দু’টি ঘটনা একই সুতোয় বেঁধে ফেলেছে পশ্চিমবঙ্গকে।
দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক পর সিপিএমকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে বাংলার ক্ষমতা দখল করেছিলেন মমতা। তাঁর সেই অশ্বমেধের ঘোড়ার জয়যাত্রা জারি আছে। গত বছর তৃতীয়বারের জন্য বাংলার মসনদে বসেছেন ‘কালীঘাটের অগ্নিকন্যা’। পক্ষান্তরে, সিপিএম-সহ বামফ্রন্ট নামতে নামতে শূন্যে এসে ঠেকেছে। সাফল্যের মুখ দেখেনি ন্যানো প্রকল্পও।
যে জমি আন্দোলনের উপর ভর করে মমতার ক্ষমতায় আগমন, তার পরতে পরতে জড়িয়ে দু’টি নাম— সিঙ্গুর এবং সেই সূত্রে ন্যানো। রতন টাটার ‘স্বপ্ন’ এক লক্ষ টাকার গাড়ি শিল্পের জন্য সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে যে বিবাদ তৎকালীন শাসক এবং বিরোধী মমতার মধ্যে বেধেছিল, তাকেই বৃহত্তর আন্দোলনের রূপ দেন মমতা। সিঙ্গুরের সঙ্গে জুড়ে যায় আরও একটি নাম— নন্দীগ্রাম।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে জমি আন্দোলন এবং তৎপরবর্তী সরকার বদলের কাহিনির সবচেয়ে প্রথম পরিচ্ছেদে ন্যানো এবং সিঙ্গুরের নামই লেখা থাকবে। যে দু’টি নামের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল রতন টাটার নামটিও। যিনি টাটা গোষ্ঠীর প্রাক্তন চেয়ারম্যান। এখন টাটা গোষ্টীর ‘চেয়ারম্যান এমিরেটাস’।
দীর্ঘ দিন ধরে জমি আন্দোলন চলার পর দুর্গাপূজা শুরুর মুখে সিঙ্গুর থেকে প্রকল্প গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রতন টাটা। বেছে নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাতকে। মোদী তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর রাজ্যের সানন্দে ন্যানো কারখানার জমি দিয়েছিলেন রতন টাটাকে। সিঙ্গুর তথা বাংলা থেকে প্রকল্প গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা করতে গিয়ে রতন টাটা জানিয়েছিলেন, তিনি ‘ব্যাড এম (মমতা)’ এবং ‘গুড এম (মোদী)’-র মধ্যে ‘গুড এম’-কে বেছে নিচ্ছেন।
যদিও শেষপর্যন্ত ন্যানো লাভের মুখ দেখেনি। গুজরাতের সানন্দে ন্যানোর উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল রতন টাটাকে। গাড়ি হিসেবে ন্যানো জনতার মন জয় করতে পারেনি। বিভিন্ন প্রযুক্তিগত গোলমাল এবং ভ্রান্তির ফলে প্রকল্প হিসেবে ন্যানো ব্যর্থই হয়েছিল। ব্যর্থ হয়েছিল রতন টাটার স্বপ্ন যে, দেশের মধ্যবিত্ত জনতাকে এক লক্ষ টাকায় গাড়ি কেনার সুবিধা দেবেন তিনি।
নিজের ইনস্টাগ্রাম পোস্টে ন্যানো তৈরির ‘আসল কারণ’ লিখেছেন রতন টাটা। যদিও সে কারণ তিনি আগেও বলেছেন। লিখেছেন, মুম্বইয়ের রাস্তায় বিভিন্ন পরিবারকে স্কুটারে যেতে দেখে, যেখানে বাবা-মায়ের মাঝখানে পরিবারের শিশু সদস্যটি স্যান্ডউইচ হয়ে কুঁকড়ে রয়েছে, প্রথম একটি সস্তা এবং নিরাপদ গাড়ির কথা ভেবেছিলেন। স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্র হওয়ায় নিজের অবসর সময়ে রতন টাটা গাড়ির নকশা নিয়ে কাজ করতেন। প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন, কী ভাবে দ্বিচক্রযানকেই আরও নিরাপদ করা যায়। যাতে আচ্ছাদন থাকলেও কোনও জানালা বা দরজা থাকবে না। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁরা ঠিক করেন চারচাকার গাড়ি বানানোই ভাল।
পোস্টের শেষে রতন টাটা লিখেছেন, ‘দ্য ন্যানো, ওয়াজ অলওয়েজ মেন্ট ফর আওয়ার পিপ্ল।’ ঘটনাচক্রে, রতন টাটার দেশবাসী ন্যানোকে আপন করে নেয়নি। যেমন তিনি সিঙ্গুর থেকে শিল্প গুটিয়ে চলে গেলেও তার কোনও প্রভাব মমতার রাজনৈতিক অগ্রগতিতে পড়েনি। উল্টে জমি আন্দোলন মমতাকে আরও শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছে। যে আন্দোলনের প্রথম পরিচ্ছেদে সিঙ্গুর এবং ন্যানোর সঙ্গেই সম্ভবত লেখা থাকবে আরও একটি নাম— রতন নভল টাটা।