Uttarkashi Tunnel Rescue Operation

ফোন বাজা বন্ধ বহু দিন, সম্মানটুকুই সম্বল নসিম-মুন্নাদের

দুর! ‘‘নামটা প্রথম শুনলাম উত্তরকাশীতে সুড়ঙ্গের সামনে বসে’’, বলছিলেন ২৯ বছর বয়সি নসিম মালিক। মাটি থেকে ৩-৪ ফুট গভীরে অনুভূমিক সুড়ঙ্গ খুঁড়তে দক্ষ যাঁরা, তাঁদের জন্য এটাই প্রচলিত নাম।

Advertisement

সীমন্তিনী গুপ্ত

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:০০
Share:

উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গ থেকে এরাই শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করেছিলেন আটকে থাকা শ্রমিকদের। —ফাইল চিত্র।

ঠিক এক মাস আগের কথা। উত্তর-পূর্ব দিল্লির খজুরী খাসের অলিগলিতে সে দিন উপচে পড়া ভিড়। সবাই এক বার দেখতে চায় নসিম, মুন্না, হাসানদের। গলায় গাঁদা ফুলের মালা আর হাতে মিষ্টির বাক্স নিয়ে মহল্লায় যখন তাঁরা ঢুকছেন, মুখে বিজয়ীর হাসি, আর চারদিকে কান ফাটানো ঢাকের বাদ্যি ও হাততালি।

Advertisement

হবে না-ই বা কেন? তার দু’দিন আগেই যে অসাধ্য সাধন করেছেন নসিমেরা। উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গ থেকে তাঁরাই শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করতে পেরেছেন ১৭ দিন আটকে থাকা ৪১ জন শ্রমিককে। যন্ত্র যে প্রতিকূলতার সামনে হার মেনে গিয়েছিল, সেই বাধাই অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা আর অধ্যাবসায় দিয়ে সরিয়ে দিতে পেরেছিলেন এই ‘র‌্যাট মাইনারেরা’।

ইঁদুর! ‘‘নামটা প্রথম শুনলাম উত্তরকাশীতে সুড়ঙ্গের সামনে বসে’’, বলছিলেন ২৯ বছর বয়সি নসিম মালিক। মাটি থেকে ৩-৪ ফুট গভীরে অনুভূমিক সুড়ঙ্গ খুঁড়তে দক্ষ যাঁরা, তাঁদের জন্য এটাই প্রচলিত নাম। ইঁদুরের মতোই নোংরা নালায় ঢুকে, গভীর গর্তে সিঁধিয়ে কাজ তাঁদের। ‘‘বিদ্যুতের তারের পাইপ, নিকাশি জলের পাইপ, খাবার জলের পাইপ বা গ্যাসের পাইপ বসাতে বা সারাতে হরহামেশা আমাদের ডাক পড়লেও এই কাজের জন্য কখনও কোনও সম্মান পাইনি। কেউ আমাদের কখনও ভাল চোখে দেখত না’’, ফোনের ও-প্রান্তে নসিমের গলায় স্পষ্ট খেদ। পরমুহূর্তেই অবশ্য উচ্ছল কণ্ঠস্বর— ‘‘আর আমাদের এখন র‌্যাট মাইনারদের রাজা বলা হচ্ছে...রাজা...শুনতে বেশ লাগছে।’’

Advertisement

নগদ ২৫ হাজার টাকা, ৫০০ টাকা মূল্যের একটা নোটের মালা আর ২০০০ টাকার একটা চেক নিয়ে যখন ৩০ নভেম্বর ঘরে ফিরেছিলেন নসিম-মুন্নারা, নিজেদের ‘রাজা-রাজা’ই মনে হচ্ছিল। ‘র‌্যাট মাইনিং’ অবৈধ হলেও তাঁরা যে কাজটা করেন, তা আইনসম্মত। কিন্তু মজুরি বড়জোর দৈনিক ৬০০ টাকা। ‘‘কিন্তু এই ধরনের কাজ করার জন্য যে ধরনের পোশাক বা যন্ত্রপাতি প্রয়োজন, বেশির ভাগ সময়েই আমরা তা পাই না। আর চোট লাগলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যবিমা, সে তো অলীক কল্পনা’’, বলছিলেন মুন্না কুরেশি।

বছর তেত্রিশের মুন্নার ঘর নসিমের বাসা থেকে একটু দূরেই। বললেন, ‘‘২২ তারিখ মাঝরাতে আমিই নসিম, ফিরোজ়, ইরশাদ, হাসান ও রসিদ— সবাইকে ফোন করে বলেছিলাম, উত্তরাখণ্ড যাওয়ার জন্য তৈরি হও ভাই সব। সুড়ঙ্গ ধসে শ্রমিকেরা আটকে পড়ে রয়েছে। আমাদের গিয়ে তাদের উদ্ধার করতে হবে।’’ খুঁড়তে খুঁড়তে এই মুন্নাই প্রথম পৌঁছেছিলেন শ্রমিকদের কাছে। তাঁকে দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরেছিলেন আটক শ্রমিকেরা।

মুন্না বলছিলেন, ‘‘জানেন, এক সপ্তাহ ধরে টানা ফোন বেজেছে আমার। একের পর এক চ্যানেল আর খবরের কাগজের সাংবাদিকেরা আমার এই ৮ ফুট বাই ১০ ফুটের ঘরটায় ভিড় জমাচ্ছিলেন। সমানে ছবি তোলা হচ্ছে, তাই ট্রাঙ্ক থেকে বার করতে হয়েছিল ইস্তিরি করে রাখা কালো ট্রাউজ়ার্স আর সাদা শার্ট, কালি মাখিয়ে চকচকে করতে হয়েছিল বুটজোড়াটাও। এত ফোন আসছিল যে, স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগটুকুও পাচ্ছিলাম না। কিন্তু ওই কয়েক দিন, ব্যস! ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভোটের ফল বেরোতে শুরু করল। আর মিডিয়ার নজর আমাদের থেকে সরে গিয়ে পড়ল সেখানে। তার পর থেকে আর আমাদের বিশেষ কেউ খোঁজ করছে না। কাজও আসছে না। দিল্লি জল বোর্ডের একটা কাজ পাওয়ার কথা আছে। সেটার আশায় বসে আছি।’’

নসিমের স্ত্রী সমিনাকে শুধোই, স্বামী যে কাজ করেছেন, তার জন্য গর্ব হয়েছে নিশ্চয়? ‘‘তা হয়েছে, তবে তার থেকেও বেশি হয়েছে ভয়। যখনই ও সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে যায়, আমার বুক ধুকপুক করে। সারা দেশ ভাবছে সুড়ঙ্গে আটকে পড়া ৪১ শ্রমিকের কথা। আর আমি ভাবছিলাম আমার স্বামী আর ওঁর সঙ্গীদের কথা। খালি মনে হচ্ছিল, ওঁদের উপরেই যদি মাটির ধস নামে! আমার স্বামী ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছেন। ওঁকে তো আর এখন অন্য কাজে পাঠাতে পারব না। তবে ছেলেমেয়েগুলোকে লেখাপড়া শেখাচ্ছি। তাদের কখনওই এই কাজে পাঠাব না।’’ সমিনা আরও জানালেন, বাড়িতে টিভি নেই, তাই ফোনে বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলেই স্বামীর সাক্ষাৎকার আর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান দেখেছেন।

এত অভিনন্দন অনুষ্ঠানের মধ্যে কুরেশির সব থেকে মনে ধরেছিল লিটল ফ্লাওয়ার্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। বললেন, ‘‘প্রধানশিক্ষিকা অনুষ্ঠানে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর সামনে বললেন, আমরাই বাস্তব জীবনের নায়ক। আমার স্বপ্ন আমার ছেলেমেয়েও এক দিন এই রকম কোনও স্কুলে পড়বে।’’

বিদ্যুতের তার বা জলের পাইপ বসানোর কাজ করলেও মানুষ উদ্ধারের কাজ নসিমদের এই প্রথম। ওয়াকিল হাসান রকওয়েল এন্টারপ্রাইজ়েস নামে খনন শ্রমিকদের একটি সংস্থা চালান। তিনিই দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দিল্লি থেকে হোয়াটসঅ্যাপে জানালেন, ‘‘সুড়ঙ্গে খননের কথা শুনে প্রথমেই হাজার দশেক টাকা খরচা করে কিনে নিই গাঁইতি, বেলচা, মাটি নিয়ে যাওয়ার জন্য চার চাকার ট্রলি। সেই সব তো কাজে লেগে ছিলই, তার সঙ্গে হাত দিয়েও মাটি সরিয়ে সরিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়েছিলাম আমরা।’’

উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু সে টাকা এখনও চোখে দেখেননি খজুরী খাসের খনন শ্রমিকেরা। এই যে প্রত্যাশামাফিক ইনাম পাচ্ছেন না, বা সেই একই কাজ করে যেতে হচ্ছে, তাতে হতাশ লাগে না?

ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে মুন্নার হালকা হাসি ভেসে আসে— ‘‘তখন তো সংবর্ধনা দিয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ মনোজ তিওয়ারি, বিধায়ক মোহন সিংহ বিস্ত, বিজেপি নেতা বীরেন্দ্র সচদেব ও আরও অনেকে। সবাই তখন আমাদের আনন্দে শামিল হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কষ্টের দিনগুলোতে পাশে আর কে থাকতে চায়, বলুন!’’

ওয়াকিলও বলেন, ‘‘ইনাম-টাকার পিছনে আর কত ছুটব। এই কাজের অনেক বিপদ। জাতীয় সড়ক, মেট্রো স্টেশন বা রেল লাইনের তলা দিয়ে যায় এই সব পাইপলাইন। মাটি ধসে যেতে পারে, তড়িদাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে প্রতিপদে। খনন করতে গিয়ে কত জন প্রাণ হারান বা গুরুতর আহত হন, তার কোনও পরিসংখ্যান নেই। তাই মাটির তলাতেই থেকে যায় আমাদের কাহিনি। কিন্তু এই কাজটার পরে সবাই আমাদের চিনেছে, দেশ-বিদেশ থেকে কত সাংবাদিক এসে আমাদের ছবি তুলে নিয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি কিছুই পাল্টায়নি। কিন্তু সম্মান মিলছে অনেক। এটাই ইনাম।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement