প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। ছবি: পিটিআই
‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার অঙ্গ হিসেবে এ বার ১০১টি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানিতে ধাপে ধাপে নিষেধাজ্ঞা চাপানোর কথা ঘোষণা করল কেন্দ্র। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, ক্ষেপণাস্ত্র, কামান, যুদ্ধে ব্যবহারের হালকা হেলিকপ্টার থেকে শুরু করে ভারী পণ্যবাহী বিমানও।
রবিবার একগুচ্ছ টুইটে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ জানান, প্রধানমন্ত্রী ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার যে ডাক দিয়েছেন, তাতে শামিল হতেই এই সিদ্ধান্ত। এমন নয় যে, এখনই এক লপ্তে এই সমস্ত পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। বরং তার প্রত্যেকটির জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী এগুলির আমদানি ধাপে ধাপে বন্ধ করা হবে ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে। অর্থাৎ আগামী লোকসভা ভোটের আগে মোদীর দ্বিতীয় দফার সরকারের মেয়াদের মধ্যেই এটা করতে চায় কেন্দ্র। এতে আগামী ৬-৭ বছরে অন্তত ৪ লক্ষ কোটি টাকার বরাত বাইরে যাওয়ার বদলে ভারতীয় সংস্থাগুলি পাবে বলেও দাবি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর। স্থল ও বিমান বাহিনীর তরফ থেকে ১.৩ লক্ষ কোটি টাকা করে। আর নৌবাহিনী থেকে ১.৪ লক্ষ কোটির।
রাজনাথের এই ঘোষণাকে কটাক্ষ করেছেন প্রাক্তন অর্থ তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। মন্ত্রক বড় ঘোষণা করতে চলেছে জানিয়ে এ দিন সকাল থেকেই তার জমি তৈরি করে রেখেছিলেন রাজনাথ। কিন্তু তাঁকে বিঁধে চিদম্বরম বলেন, “প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের একমাত্র আমদানিকারী প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। তাই তাদের এই নিষেধাজ্ঞার অর্থ নিজেদের উপরেই তা চাপানো! প্রতিরক্ষামন্ত্রী যাকে রবিবারের ঐতিহাসিক ঘোষণা বলে দাবি করছিলেন, আসলে তা নিছকই সচিবদের প্রতি তাঁর সরকারি নির্দেশ!”
অনেক দিন ধরেই অস্ত্র এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানিতে বিশ্বে একেবারে প্রথম সারিতে ভারত। রাজনাথ নিজেই জানিয়েছেন, যে ধরনের পণ্যে নিষেধাজ্ঞা চাপানোর কথা বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের অগস্টের মধ্যে শুধু সেই খাতেই বরাত দেওয়া হয়েছে প্রায় ৩.৫ লক্ষ কোটি টাকার। পরিসংখ্যান বলছে, এক সময়ে এই প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের বেশির ভাগটাই আসত রাশিয়া থেকে। এখন সেই বরাতে ভাগ বসিয়েছে আমেরিকা, ইজ়রায়েল, ফ্রান্সের মতো দেশ। কিন্তু বহু দিন ধরেই প্রশ্ন, এই সব অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের একটা বড় অংশ ভারতে কেন তৈরি হয় না?
আরও পড়ুন: ‘তিনি’ যে ও ঘরে কে তা জানত! সব রিপোর্ট নেগেটিভ, হাঁফ ছাড়ল বঙ্গ বিজেপি
আরও পড়ুন: আইসোলেশনেও আফসোস নেই, শতাধিক প্রাণ বাঁচিয়ে বলছেন মান্নান-আফজলরা
অনেকে মনে করেন, দেশে এগুলি তৈরি হলে, আমদানি-নির্ভরতা কমবে। গুনতে হবে না বিপুল অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা। সেই সঙ্গে প্রতিরক্ষা শিল্পের হাত ধরে কাজের সুযোগ তৈরি হবে দেশে। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, আমদানি ছেঁটে ফেলতে গিয়ে পণ্যের গুণমানের সঙ্গে আপস করতে হবে না তো? কেন্দ্রের আশ্বাস, ১০১টির তালিকার প্রত্যেক পণ্যের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা আছে। অর্থাৎ ইঙ্গিত, তার মধ্যে ওই সরঞ্জাম তৈরিতে সয়ম্ভর হয়ে তবে বন্ধ করা হবে আমদানি।
কিন্তু এ ক্ষেত্রেও চিদম্বরমের কটাক্ষ, “আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা বেশ খটমট শব্দ। এই ক্ষেত্রে এর মানে হল, এখন আমরা যে যে সরঞ্জাম আমদানি করি, আগামী ২-৪ বছরে সেগুলিই তৈরির চেষ্টা করা হবে। আমদানি বন্ধ করা হবে তার পরে!” অর্থাৎ তাঁর আশঙ্কা, এখন আমদানি করা সরঞ্জাম যখন দেশে তৈরি করা রপ্ত হবে, তত দিনে বিশ্ব বাজারে এসে পড়বে উন্নততর প্রযুক্তি। সেই নতুন মানের সরঞ্জাম সেনাবাহিনীর তিন বিভাগ পাবে তো? রাজনাথের আশ্বাস, এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে আলোচনায় বসা হয়েছে তিন বাহিনীর সঙ্গে। তালিকা তৈরি হয়েছে তাদের মতামত নিয়েই।
‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প ঘোষণার পরে গোড়া থেকেই প্রতিরক্ষায় লগ্নির জন্য দেশীয় সংস্থাগুলিকে এগিয়ে আসার ডাক দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই ক্ষেত্রে পা রেখেছে টাটা, মহীন্দ্রা, রিলায়্যান্স, আদানির মতো গোষ্ঠী। প্রতিরক্ষায় বিদেশি লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা শিথিল হওয়ার পর থেকে তাদের অনেকে গাঁটছড়া বেঁধেছে বিভিন্ন প্রতিরক্ষা বহুজাতিকের সঙ্গে। এ দিনের ঘোষণা খুশি করবে প্রতিরক্ষায় পা রাখা দেশীয় সংস্থাগুলিকে। রাজনাথ জানিয়েছেন, চলতি আর্থিক বছরের বাজেটেই ৫২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে শুধুমাত্র দেশীয় সংস্থাগুলিকে বরাত দেওয়ার জন্য।
কিন্তু প্রশ্ন হল, বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে তালিকায় থাকা সমস্ত পণ্য কি সত্যিই আধুনিকতম প্রযুক্তিতে দেশের মাটিতে তৈরি করতে পারবে দেশীয় সংস্থাগুলি? নাকি শুধু ভারতে তাদের কারখানা ব্যবহার করে পণ্য তৈরি করবে সেই বিদেশি সংস্থাই? সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তি হস্তান্তর হবে কতখানি? সদ্য কেনা রাফালের মতো বিমান, চিনুকের মতো হেলিকপ্টারও কি দীর্ঘ মেয়াদে তৈরি হবে দেশে? কেন্দ্রের দাবি, আগামী দিনে স্বয়ম্ভরতা মেপে ক্রমশ আরও লম্বা হবে নিষেধাজ্ঞার তালিকা।