দিন দুয়েক আগে ভিডিও বার্তায় কার্যত মুচলেকা দিয়েছিলেন খোদ পরিচালক। বলেছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্রের’ শিল্পীদের নিয়ে তিনি কাজ করবেন না। ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’-এর মুক্তিতে বাধা কাটাতে এ বার দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে হত্যে দিতে হল প্রযোজকদের। মন্ত্রী অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, চিন্তা নেই। দিওয়ালিটা ভালই কাটবে তাঁদের।
দিওয়ালির দু’দিন আগে, ২৮ অক্টোবর মুক্তি পাওয়ার কথা কর্ণ জোহর পরিচালিত ‘অ্যায় দিল...’-এর। কিন্তু উরির সেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হানা, ভারতের পাল্টা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং তার প্রেক্ষাপটে রাজ ঠাকরের এমএনএসের পাক শিল্পী বয়কটের ডাক একটু একটু করে বহুমুখী রোষের মুখে ঠেলে দিয়েছে কর্ণের ছবিকে। কখনও হল-এ ভাঙচুরের হুমকি দিয়েছে এমএনএস, কখনও চার রাজ্যে ছবিটি না দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিঙ্গল স্ক্রিন হলমালিকদের সংগঠন। এ সবের একমাত্র কারণ, এই ছবিতে রয়েছেন পাক অভিনেতা ফাওয়াদ খান। কর্ণের বিবৃতির পরেও জারি রয়েছে হুমকি-বিক্ষোভ।
এই পরিস্থিতিতে আজ কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী তথা গায়ক বাবুল সুপ্রিয়র মধ্যস্থতায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে দেখা করেন ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন গিল্ড অব ইন্ডিয়ার সভাপতি মুকেশ ভট্ট, কর্ণের ধর্মা প্রোডাকশনসের পদস্থ কর্তা অপূর্ব মেটা-সহ কয়েক জন। বৈঠকের পরে মুকেশ জানান, তাঁদের যাবতীয় সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘অ্যায় দিল...’-এর মুক্তিতে কোনও বিঘ্ন ঘটবে না। ওই সময় আইন-শৃঙ্খলা যাতে বজায় থাকে, তা নিশ্চিত করতে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি কথা বলবেন। প্রয়োজনে বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। মুকেশের কথায়, ‘‘আমরা এখন নিরাপদ বোধ করছি।’’
সত্যিই ‘মুশকিল আসান’ হল কি? বিরোধী রাজনৈতিক শিবির থেকে শুরু করে অনেকেই মনে করছেন, দেশে অসহিষ্ণুতা কোন পর্যায়ে উঠেছে, ‘অ্যায় দিল..’-এর পরিচালক-প্রযোজকদের প্রতিটি পদক্ষেপেই তা স্পষ্ট। অনেকে এ-ও বলছেন, সৃষ্টিশীল মানুষদেরও যে কোণঠাসা করে আপসের রাস্তায় টেনে আনা যায়, নরেন্দ্র মোদী জমানা তার প্রমাণ। আর যাঁরা আপস না করে প্রশ্ন তোলেন, তাঁদের হয়রান হতে হয় নানা ভাবে।
‘অ্যায় দিল...’ প্রসঙ্গে যেমন সলমন খানের উদাহরণ প্রথমে টানছেন তাঁরা। লোকসভা ভোটের আগে মোদীর সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ানো সলমন সম্প্রতি পাক শিল্পী বয়কটের ডাকের বিরোধিতা করেন। ঘটনাচক্রে, তার পরেই সলমনের বিরুদ্ধে চিঙ্কারা মামলা খুঁচিয়ে তুলেছে রাজস্থানের বিজেপি সরকার। পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ ক’দিন আগে কর্ণের পাশে দাঁড়িয়ে মোদীকে টুইটারে বলেছিলেন, পাকিস্তান যাওয়ার জন্য ক্ষমা চান তিনি। বলিউডে গুঞ্জন, সেই অনুরাগ এখন আয়কর দফতরের নোটিস পেয়েছেন। বাড়িতে আয়কর দফতরের হানার আশঙ্কা করছেন তিনি।
বলিউডের আরও ভয়, এর পরে হিন্দু জাতীয়বাদীদের কোপের মুখে পড়তে পারে শাহরুখ খানের ছবি ‘রইস’। কারণ সেই ছবিতে রয়েছেন পাক অভিনেত্রী মাহিরা খান। কর্ণের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাহরুখ নিজের ছবির ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ‘অ্যায় দিল...’ বিতর্কে নীরব রয়েছেন কি না, সেই প্রশ্নও এখন উঠছে। দাদরি-কাণ্ডের পরে অসহিষ্ণুতা নিয়ে মুখ খুলে এমন বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন শাহরুখ যে, কটাক্ষের সুরে হলেও তাঁকে বলতে হয়েছিল, ‘‘আমার দেশে সব ঠিক আছে।’’ আমির খান বলেছিলেন, চারপাশের পরিবেশের কথা ভেবে স্ত্রী তাঁকে প্রশ্ন করেছেন, তাঁদের দেশ ছাড়া উচিত কি না। সে কথা বলার পর খোদ প্রতিরক্ষামন্ত্রী নাম না করে আমিরের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ক’দিন আগে কমেডিয়ান কপিল শর্মা অভিযোগ করেছিলেন, মুম্বইয়ে একটি বাড়ি তৈরির সময়ে পুরসভার কর্মী তাঁর কাছে ঘুষ চান। মোদীর টুইটারে কপিল লেখেন, ‘এই আপনার অচ্ছে দিন?’ তার পরেই কপিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, নিয়ম ভেঙে মুম্বইয়ে অফিস বানাচ্ছিলেন তিনি।
বিজেপি নেতারা এই সব অভিযোগই উড়িয়েছেন। তবে অমিত শাহ-ঘনিষ্ঠ নেতা শ্রীকান্ত শর্মা সরাসরিই বলেছেন, ‘‘গোটা দেশে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে রোষ রয়েছে, বলিউডেও তার প্রতিফলন ঘটা উচিত।’’ বিজেপি সূত্রে একান্তে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তাবড় শিল্পী ও শিল্পপতিরা এখন দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলছেন। সেখানে বলিউডের একটি অংশ কেন বিপথগামী হতে চাইছে? এঁদের বোঝাতেই কাজে লাগানো হচ্ছে মোদীর ঘনিষ্ঠ সাংসদ-অভিনেতা পরেশ রাওয়ালকে। বাজপেয়ী-আডবাণীর জমানায় এই কাজটাই করতেন শত্রুঘ্ন সিন্হা। আডবাণী নিয়মিত ছবি দেখতেন। অভিনেতাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎও হতো তাঁর। বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, দূরত্ব ঘোচাতে তেমনই একটি সমান্তরাল চেষ্টা জারি রয়েছে এখনও।