বাহানগা বাজারে রেলপথ সারানোর কাজ শেষ, জানিয়ে দিল রেল। ছবি: পিটিআই।
ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর কেটে গিয়েছে বেশ খানিকটা সময়। শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিট নাগাদ ভয়াবহ ওই কাণ্ডে এত মানুষের মৃত্যুর প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছে খানিকটা। তার পরই রেল ঝাঁপিয়ে পড়েছে দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ সারানোর কাজে। দুর্ঘটনার পর বহু মানুষ পৌঁছে গিয়েছিলেন সেখানে। উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু শনিবার রাত থেকেই কাউকে আর ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি দুর্ঘটনাস্থলের ধারেকাছে। ওই সময় থেকেই এলাকা ঘিরে ফেলে রেল এবং রাজ্য সরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের বিশাল দল। তাঁদের কড়া নজর রয়েছে দুর্ঘটনাগ্রস্ত বগিগুলির উপরেও। যাতে কেউ সেখানে ঢুকে না পড়েন। রেল কর্তৃপক্ষের মূল লক্ষ্য, খুব দ্রুত ওই রেললাইন সারিয়ে ফেলা।
শনিবার থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েক হাজার রেলকর্মীর উদয়াস্ত পরিশ্রমের ফলও মিলেছে। রবিবার রাত ১০টা ৪০ মিনিটে ডাউন লাইনে প্রথমে একটি মালগাড়ি চালানো হয়। এর পর রাত ১১টা ৩৯ মিনিটে চালানো হয় আরও একটি মালগাড়ি। আপ লাইনে প্রথম ট্রেনটি চালানো হয় রাত ১২টা বেজে ৫ মিনিটে। সেই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। সোমবার সকালে ওই রেলপথে চলে বন্দে ভারত এক্সপ্রেস। কিছুটা পরে আপ লাইন দিয়ে যায় ফলকনুমা এক্সপ্রেসও। রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই রেলপথ সারানোর কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে সোমবার।
মঙ্গলবার থেকে ওই রেলপথে সোমবারের তুলনায় ট্রেনের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেও রেলের তরফে জানানো হয়েছে। তবে দুর্ঘটনাস্থলে ট্রেনের গতিবেগ অত্যন্ত কম বলেও জানা গিয়েছে রেল সূত্রে। ট্রেন যাওয়ার সময় গতির দিকে রয়েছে কড়া নজরদারি। কন্ট্রোল রুমে বসে সে দিকে নজরদারি চালাচ্ছেন রেলের আধিকারিকরা। সোমবার ঘটনাস্থলে যান দক্ষিণ-পুর্ব মুখ্য জন সংযোগ আধিকারিক আদিত্য চৌধরি। তিনি জানিয়েছেন, ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছন্দে ফেরানো হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত ২৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে রেলের তরফে জানানো হয়েছে (যদিও ওড়িশা সরকারের সংশোধিত হিসাবে এই সংখ্যা ২৭৫)।
শেষ রেলপথ সারানোর কাজ
মারাত্মক ওই দুর্ঘটনার পর দুমড়েমুচড়ে যাওয়া রেলপথ সারিয়ে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা চ্যালেঞ্জ ছিল রেলকর্মীদের কাছে। দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলে বাহানগা বাজার স্টেশনে রেলপথ সারানোর কাজ শেষ হয়েছে সোমবার। দিন ভর ৪০টির বেশি ট্রেন চলেছে ওই রেলপথে। তবে ঘটনাস্থলে ট্রেনের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় মাত্র ১০ কিলোমিটার। মঙ্গলবার ট্রেনের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে বলে রেল সূত্রে জানা গিয়েছে। ওই এলাকা এখনও ঘিরে রেখেছে পুলিশ। রয়েছে ব্যারিকেডও। ওই এলাকায় রবিবার থেকে প্রবেশ নিষেধ সংবাদমাধ্যমেরও। ওই রেলপথে পড়ে থাকা দুর্ঘটনাগ্রস্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল আগেই। এর পর ভেঙে যাওয়া স্লিপার বদলানো হয়। লাগানো হয় প্যান্ড্রোল ক্লিপ এবং চিপসও। সমস্ত কিছু ঠিকঠাক রয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হয় বার বার। সারানো হয় ভেঙে যাওয়া লুপ লাইনও। দ্রুত পরিষেবা স্বাভাবিক করতে মরিয়া রেল কর্তৃপক্ষও।
বাতিল একাধিক ট্রেন
করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার পর থেকে ওই রেলপথে বাতিল এক্সপ্রেস এবং স্পেশাল-সহ একাধিক ট্রেন। রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার হাওড়া-কন্যাকুমারী এক্সপ্রেস, হাওড়া-পুরী এক্সপ্রেস, হাওড়া-ভদ্রক এক্সপ্রেস, শালিমার-ভঞ্জপুর এক্সপ্রেস, বালেশ্বর-ভদ্রক-বালেশ্বর স্পেশাল ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। মোট ৮৫টি ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে ৩টি এক্সপ্রেসের। রেলের বক্তব্য, দুর্ঘটনাস্থল দিয়ে মাত্র ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার বেগে যাচ্ছে ট্রেন। এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য স্টেশনে ট্রেন আটকে পড়ছে। ফলে ওই এলাকা দিয়ে পূর্ণ গতিতে ট্রেন না চললে স্বাভাবিক হবে না পরিষেবা। এ ছাড়াও আরও কারণ রয়েছে। বহু ট্রেন বাতিল হওয়ার কারণ অনেক সময় ডাউন ট্রেন আসেনি। ফলে সেই ট্রেনগুলি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন রেল কর্তৃপক্ষ।
কোন পথে দুর্ঘটনার তদন্ত
দু্র্ঘটনার তদন্ত শেষ করতে আরও ২ থেকে ৩ দিন সময় লাগবে। সোমবার জানিয়ে দিয়েছেন রেলের তদন্তকারী দলের প্রধান রেল সুরক্ষা কমিশনার (দক্ষিণ-পূর্ব সার্কল) এএম চৌধুরী। খড়্গপুরে তিনি জানিয়েছেন, সাক্ষ্যগ্রহণ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৫-৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁরা সকলেই ট্রেনের কর্মী এবং চালক। গ্রামবাসীদের সাক্ষ্য এখনও নেওয়া হয়নি। কেউ সাক্ষ্য দিতে চাইলে, তা গ্রহণ করার জন্য রেল প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘এটা এতটাও সহজ নয় যে, ২-৩ জনকে জিজ্ঞেস করলেই হয়ে যাবে। আরও ২-৩ দিন সময় লাগবে।’’ যদিও রবিবার সকালে দুর্ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে রেলমন্ত্রী বলেছিলেন, “রেলের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কমিশনার (সিআরএস) শনিবার দুর্ঘটনাস্থলে ছিলেন... সিআরএস সকলের সঙ্গে কথা বলেছেন, এবং দ্রুত তদন্ত এগিয়েছেন। দুর্ঘটনার মূল কারণ চিহ্নিত করা গিয়েছে।’’ এর পরই তিনি বলেন, ‘‘এই কাজ যাঁরা ঘটিয়েছেন তাঁদেরও চিহ্নিত করে ফেলা হয়েছে। সিআরএস তদন্ত রিপোর্ট, এই দুর্ঘটনার কারণ খুব শীঘ্রই জানা যাবে।’’ রেলের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কমিশনার অবশ্য আরও কিছুটা সময় লাগার কথা জানিয়েছেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে সিগন্যাল, ইন্টারলকিং সিস্টেম, সবই খতিয়ে দেখা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। রেলওয়ে বোর্ড বালেশ্বরের ঘটনায় সিবিআই তদন্তের সুপারিশ করেছে। সিবিআই তদন্ত করলে কি সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হবে? সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চৌধুরী এই সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘২টো তদন্ত পাশাপাশি চলতে পারে। তাতে কিছু যায় আসে না। ওদের দেখার অ্যাঙ্গেল (দৃষ্টিকোণ) এক, আমাদের আর এক। কোনও অসুবিধা নেই।’’