সেঞ্চুরি হল না। আট বছর আগেই ইতিহাসের পাতায় চলে গেল রেল বাজেট।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা আজ সিদ্ধান্ত নিল, ছেদ টানা হবে ৯২ বছরের প্রথায়। সামনের বছর থেকে আর রেল বাজেট পেশ হবে না। সাধারণ বাজেটেই ঘোষণা হবে রেলের প্রকল্প ও আয়-ব্যয়ের খতিয়ান। সাধারণ বাজেটে পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা-বহির্ভূত খাতও আর আলাদা করে দেখানো হবে না। এখনকার নিয়মে বাজেট রূপায়ণ হতে সেপ্টেম্বর গড়িয়ে যায়। সেটিকে মার্চের মধ্যে বেঁধে রাখতে সরকার চাইছে ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট পেশ করতে। এর জন্য সংসদের বাজেট অধিবেশনও এগিয়ে এনে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করতে হবে। উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাবের মতো রাজ্যে নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে সকলের সঙ্গে আলোচনা করেই অবশ্য চূড়ান্ত দিনক্ষণ স্থির করতে চাইছে কেন্দ্র।
কেন রেল বাজেট তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সরকার?
• মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির ব্যাখ্যা, সাধারণ বাজেটের পাশাপাশি আলাদা রেল বাজেট পেশের প্রথা চালু হয়েছিল ১৯২৪ সাল থেকে। তখন রেলের খরচ ছিল সাধারণ বাজেটের থেকেও বেশি। এই অবস্থা ধীর ধীরে বদলে গিয়েছে। এখন প্রতিরক্ষা বা সড়ক পরিবহণের বাজেট অনেক সময় রেলকে ছাপিয়ে যায়।
• নীতি আয়োগের সদস্য বিবেক দেবরায়ের নেতৃত্বে কমিটিও সুপারিশ করেছিল, ব্রিটিশ জমানার এই প্রথা জিইয়ে রাখা অর্থহীন।
• রেলের বৃহত্তর আর্থিক সংস্কারের লক্ষ্যেও এটা জরুরি ছিল বলেই মনে করেন রেল বিশেষজ্ঞরা।
• রেল বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বিবেক সহায় বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ধরেই এই দাবি উঠছিল। এতে রেলের আর্থিক স্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। টাকার জন্য আর অর্থ মন্ত্রকের কাছে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হবে না।’’
• রাজনীতির কবল থেকে রেলকে মুক্ত করার ক্ষেত্রেও এই পদক্ষেপ কাজে আসবে বলে জানাচ্ছেন কেন্দ্রের এক মন্ত্রী।
তাঁর বক্তব্য, ১৯৯৬ সালে যখন থেকে এ দেশে জোট সরকার শুরু হয়েছে, তখন থেকেই রেল বাজেটকে ‘জনপ্রিয়তা’ বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারের শরিক দলকে দেওয়া হয়েছে রেলের ভার। আর সেই শরিক নেতারা রেলমন্ত্রী হয়ে দেদার নতুন ট্রেন, নতুন লাইনের ঘোষণা করেছেন। বিন্দুমাত্র নজর দেননি রেলের পরিকাঠামোর দিকে। আখেরে ক্ষতি হয়েছে রেলেরই।
এই কারণেই প্রথমে ডি ভি সদানন্দ গৌড়া এবং এর পর সুরেশ প্রভু— প্রথম থেকেই রেলকে বিজেপির হাতে রেখেছেন নরেন্দ্র মোদী। যাতে মন্ত্রকের মূল ভাবনার আমূল পরিবর্তন করা যায়। প্রভু ছিলেন শিবসেনাতে। তাঁকেও রেল মন্ত্রক দেওয়া হয়েছে দল ছেড়ে বিজেপিতে আসার পরেই। প্রভুর রেল বাজেটে নতুন ট্রেনের ঘোষণা ছিল না। এ বারে সংস্কারের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে বাজেটটিই তুলে দিলেন মোদী। যা নিয়ে কিছুটা আক্ষেপের সুর শোনা গেল রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর গলায়, ‘‘আমি আর রেল বাজেট পেশ করতে পারব না।’’ তবে জেটলির পাশে বসে তিনি এ-ও বলেন, ‘‘দেশের স্বার্থে এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল। দেশের আর্থিক বৃদ্ধিতে রেল আরও জোর দেবে।’’
প্রাক্তন রেলমন্ত্রীরা সকলে একে খোলা মনে স্বাগত জানাচ্ছেন না। যেমন মুকুল রায়ের কথায়, ‘‘এই সিদ্ধান্ত যদি ঠিক হয় তবে তো বলতে হয় আগের প্রধানমন্ত্রীরা সকলেই পৃথক রেল বাজেট রেখে মূলত ভুল করেছেন।’’ আর এক প্রাক্তন রেলমন্ত্রী, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বলেন, ‘‘রেলের সঙ্গে মানুষের আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। সেটিকে লঘু করে দেখছে এই সরকার।’’
কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী এখন উত্তরপ্রদেশ সফরে। তাঁর দাবি, ‘‘সরকার রেল বাজেট তুলে দিচ্ছে। এ বারে কৃষি নিয়ে আলাদা বাজেট হোক।’’ যা শুনে জেটলির কটাক্ষ, ‘‘দশ বছরে তাঁদের জমানায় এই ভাবনা মাথায় এল না কেন?’’
সরকারি ভাবে দাবি করা হচ্ছে, আলাদা রেল বাজেটের প্রথা তুলে দিলেও রেলের স্বায়ত্তশাসনে হাত দেওয়া হবে না। যদিও এ নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। এক পক্ষের বক্তব্য, এত দিন রেলের অফিসারেরা যে সিদ্ধান্ত নিতেন, এখন তা নেবেন আমলারা। ফলে আমলাতান্ত্রিক জট বেড়ে যাওয়ার বাড়ার আশঙ্কা থাকছে। যদিও অন্য পক্ষের যুক্তি, এত দিন প্রকল্প রূপায়ণ থেকে আর্থিক বরাদ্দ বণ্টন যে সমীকরণ মেনে হয়েছে তা বদলাচ্ছে না। আগের মতোই হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্পে ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষমতা থাকছে রেল মন্ত্রকের হাতে। প্রকল্প হাজার কোটি টাকার বেশি হলে রেলের পাশাপাশি তাতে ছাড়পত্র দেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার আর্থিক বিষয় সংক্রান্ত কমিটি।
তবে সব মিলিয়ে অর্থ মন্ত্রকে অরুণ জেটলির গুরুত্ব এতে আরও বাড়ল বলেই মনে করছেন অনেকে। রেল বাজেট সাধারণ বাজেটের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় রেলকে আর কেন্দ্রীয় অর্থ সাহায্যের বিনিময়ে ফি বছর ডিভিডেন্ড দিতে হবে না। আর অর্থ মন্ত্রক বলছে, ডিভিডেন্ড না এলেও তাদের বিশেষ কোনও ক্ষতি হবে না। ১০ হাজার কোটি টাকা ডিভিডেন্ড হিসেবে এলে তা থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা রেলের কাজেই খরচ হয়ে যেত। আর জেটলির যুক্তি, বেতন কমিশন থেকে রেলের যাবতীয় বোঝা এত দিন অর্থ মন্ত্রক থেকেই বহন করা হতো। রেলের স্বাধীনতা বজায় থাকলেও শুধুমাত্র আয়-ব্যয়ের খতিয়ানটি এ বার সাধারণ বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করা হল।
বাজেট প্রক্রিয়ায় সংস্কার আনতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা আজ আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাধারণ বাজেটে পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা-বহির্ভূত বাজেটও আর পেশ করা হবে না। ইউপিএ আমলেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আর্থিক উপদেষ্টা সি রঙ্গরাজনের নেতৃত্বে এক কমিটি এই সুপারিশ করেছিল। পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ ‘ভাল’ আর পরিকল্পনা-বহির্ভূত খাতে বরাদ্দ মানেই ‘অপচয়’— এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে মোদী সরকার।