রাহুল গাঁধী।
বিতর্কে ঘি ঢেলেছে রঘুরাম রাজনদের কড়া সমালোচনা। কর্পোরেট সংস্থাকে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক খুলতে অনুমতি দেওয়ার প্রাথমিক সুপারিশকে হাতিয়ার করেই মঙ্গলবার দিনভর মোদী সরকারকে বিঁধলেন বিরোধীরা।
ভারতে এখন ব্যাঙ্কিং লাইসেন্স পাওয়ার শর্ত খুব কড়া। কর্পোরেট সংস্থার জন্য তা মোটের উপরে বন্ধ। কিন্তু সম্প্রতি ওই সংস্থাগুলিকে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে প্রবেশের অনুমতি দিতে সুপারিশ করেছে শীর্ষ ব্যাঙ্কের অভ্যন্তরীণ কমিটি। গতকাল তার তীব্র সমালোচনা করেছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন এবং প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য। তারপরই আক্রমণের ঝাঁঝ বেড়েছে বিরোধীদের।
মোদী সরকারকে ‘স্যুট-বুটের সরকার’ তকমা দিয়ে গোড়া থেকেই রাহুল গাঁধীর অভিযোগ, বড় কর্পোরেট সংস্থার ঋণ মকুবের টাকা জোগাড় করতেই নোটবন্দির পথে হেঁটেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। করোনা-কালে দরিদ্রদের হাতে নগদ সে ভাবে না-জোগালেও, বিপুল কর ছাঁটাইয়ের সুবিধা দিয়েছেন শিল্পপতিদের। আজ তাঁর টুইট, “ঘটনা পরম্পরা মন দিয়ে বুঝুন। প্রথমে বিপুল অঙ্কের ঋণ মকুব করা হল বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলির। তার পরে দেওয়া হল (কর্পোরেট) কর ছাঁটাইয়ের সুবিধা। আর এ বার সাধারণ মানুষের সঞ্চিত অর্থ ওই সমস্ত সংস্থার তৈরি ব্যাঙ্কে জমা করার ব্যবস্থা হচ্ছে।” বিজেপি সূত্রে পাল্টা কটাক্ষ, একের পর এক নির্বাচনে হার। কপিল সিব্বল থেকে গুলাম নবি আজ়াদ- দলের নেতৃত্বের উপরে আস্থা খুইয়ে মুখ খুলছেন প্রবীণ নেতারা।
আরও পড়ুন: সুর না মিললেই রাষ্ট্রদ্রোহ কেন! প্রশ্ন বম্বে হাইকোর্টের
ঘটনা পরম্পরা বোঝার সময় এসেছে রাহুলেরই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কমিটির সুপারিশে সরকারের ভূমিকা কোথায়, কৌশলে সেই প্রশ্নও ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে সরকারি সূত্রে। কিন্তু এ দিন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের অভিযোগ, খাতায়-কলমে সুপারিশ শীর্ষ ব্যাঙ্কের হলেও, এই উদ্যোগ আসলে নরেন্দ্র মোদীর। নোটবন্দির সিদ্ধান্তে যেমন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সায় ছিল না, তেমন এ ক্ষেত্রেও ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট সংস্থাগুলির স্বার্থসিদ্ধির জন্য শীর্ষ ব্যাঙ্ককে সামনে রেখে এই রাস্তা খুলে দিতে চাইছেন মোদী। তাঁর কথায়, “শেষ পর্যন্ত কর্পোরেট সংস্থাকে লাইসেন্স দেওয়া হলে, কারা তা সবার আগে পাবে, তা সারা পৃথিবীর জানা।” অর্থাৎ, নাম না-করেও নিশানা রিলায়্যান্স কর্ণধার মুকেশ অম্বানী, আদানি গোষ্ঠীর গৌতম আদানিরা।
কর্পোরেটের হাতে ব্যাঙ্ক
পক্ষে যুক্তি
• ব্যাঙ্কের সংখ্যা বাড়বে। ফলে বাড়বে প্রতিযোগিতা। লাভ গ্রাহকের।
বিপক্ষে বক্তব্য
• যে সংস্থা ঋণপ্রার্থী, ব্যাঙ্কের মালিকানা তাদের হাতেই থাকলে, ধার পাওয়ার যোগ্যতার নিরপেক্ষ মূল্যায়ন হবে কি?
• তৈরি হবে নিজেদের ‘খারাপ’ (যাতে টাকা শোধের সম্ভাবনা কম) প্রকল্পকেও সস্তায় (কম সুদে) ঋণ পাইয়ে দেওয়ার প্রবণতা। পরে টাকা ফেরত না-পেলে, লাফিয়ে বাড়বে অনুৎপাদক সম্পদ (এনপিএ)।
•নিজেদের খারাপ প্রকল্পে টাকা জুগিয়েও পরে বেগতিক বুঝলে, দেউলিয়া ঘোষণা করে দিতে পারবে ব্যাঙ্ক। আমানতকারীরা আতান্তরে পড়বেন। সাধারণ মানুষের করের টাকায় ব্যাঙ্ক বাঁচাতে হবে সরকারকে।
• দেশে ব্যাঙ্কে মোট জমার অঙ্ক প্রায় ১৪০ লক্ষ কোটি টাকা। এই বিপুল অঙ্কের একটি বড় অংশ গুটিকয় কর্পোরেটের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা। একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি হতে পারে ব্যাঙ্কিংয়ের বাজারে।
• লাইসেন্স পেতে পারে রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী কিছু সংস্থা। সে ক্ষেত্রে আর্থিক সম্পদ আরও বেশি করে কুক্ষিগত হবে মুষ্টিমেয় কয়েক জনের হাতে। আশঙ্কা তাদের স্বার্থে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে ক্রমে দুর্বল করে দেওয়ারও।
কেন তিনি এবং তাঁর দল ব্যাঙ্ক খোলার চাবি কর্পোরেটের হাতে দেওয়ার বিরোধী, সে বিষয়ে চিদম্বরমের দাবি, “পৃথিবীর সর্বত্র ব্যাঙ্কে মালিকানা বা অংশীদারি যত বেশি সম্ভব লোকের হাতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে সম্পদ ও ক্ষমতা কুক্ষিগত না হয়। মালিকানা এবং পরিচালনার মধ্যে থাকে চওড়া ‘দেওয়াল’। যাতে সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা থাকে। আর নিশ্চিত করা হয় যাতে, ঋণদাতা ও গ্রহীতা একই সংস্থা না হয়।” ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে কর্পোরেট সংস্থা ঢুকলে তিনটি রক্ষাকবচই নষ্ট হবে বলে তাঁর আশঙ্কা।
সম্প্রতি বেকায়দায় পড়া ইয়েস ব্যাঙ্ক, লক্ষ্মী বিলাস ব্যাঙ্ক ইত্যাদিকে বাঁচাতে যে ভাবে সরকারকে এগিয়ে আসতে হয়েছে, সেই উদাহরণ টেনে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী জানান, রাজন ও আচার্যের বিরোধিতার তিনি পূর্ণ সমর্থক।
আরও পড়ুন: কেন ধর্মঘটে নেই বিএমএস, প্রশ্ন
এ প্রসঙ্গে সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির টুইট, “লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ধার শোধ করেননি মোদীর ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিরা। ব্যাঙ্কিংয়ে কর্পোরেট সংস্থা পা রাখলে, লুট হবে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতামত অগ্রাহ্য করা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে কেন্দ্র।”