সংসদে বক্তৃতায় রাহুল গান্ধী ছবি পিটিআই।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেকে ‘কামদার’ তকমা দিয়ে গান্ধী পরিবারকে ‘নামদার’ বলে নিশানা করতেন। আজ রাহুল গান্ধী নরেন্দ্র মোদীকে ‘শাহেনশাহ’, ‘রাজা’, ‘মাস্টার অব মাস্টার্স’ বলে নিশানা করলেন।
সংসদে দাঁড়িয়ে রাহুল আজ অভিযোগ তুললেন, মোদী শাহেনশাহের মতো দেশ চালাচ্ছেন। তিনি এমন এক রাজা, যিনি কারও কথা কানে তোলেন না, রাজ্যের সমস্যার কথায় কান দেন না। এক বছর ধরে, কোভিডের সময়ে রাস্তায় বসে থাকা পঞ্জাবের চাষিদের কথাও শোনেন না। কংগ্রেস ১৯৪৭-এ রাজার শাসনের ধারণাটাই ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু এখন রাজার শাসন ফিরে এসেছে। নরেন্দ্র মোদীকে সরাসরি নিশানা করে তিনি অভিযোগ তুলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত ভাবে ইজ়রায়েল সফরে গিয়ে পেগাসাস কিনে এনেছেন। এবং এখন বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন ও পেগাসাসকে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে।
নরেন্দ্র মোদী সুযোগ পেলেই কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্রের দিকে আঙুল তুলে গান্ধী পরিবারকে নিশানা করেন। জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে গান্ধী পরিবারকে দেশের যাবতীয় সমস্যার জন্য দায়ী করেন। আজ রাহুল পাল্টা আক্রমণে গিয়ে বলেন, ‘‘আমার বাবার মাতামহ দেশ নির্মাণে জীবনের ১৫ বছর জেলে ছিলেন। আমার ঠাকুমার শরীরে ৩২টি গুলি লেগেছিল।বাবার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।’’
রাহুল বরাবরই অভিযোগ করেন, মোদী জমানায় দুই ভারত তৈরি হয়েছে— ধনীদের ভারত ও গরিবদের ভারত এবং দেশের সব কিছুই তুলে দেওয়া হচ্ছে অম্বানী ও আদানি গোষ্ঠীর হাতে। সেই ‘ডাবল এ ভেরিয়েন্ট’ অর্থনীতির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। আজ সংসদেও তিনি একই অভিয়োগ করেন। ফারাক হল, আজ সংসদে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার ধন্যবাদজ্ঞাপন প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কে রাহুল চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক হয়ে সরাসরি মোদী সরকারকে নিশানা করেছেন।
নিজেকে ‘জাতীয়তাবাদী’ বলে অভিহিত করে আজ রাহুল অভিযোগ তুলেছেন, মোদী জমানায় বিদেশনীতির ভুলে পাকিস্তান ও চিন এককাট্টা হয়েছে। এত দিন ভারতের বিদেশনীতির মূল মন্ত্রই ছিল চিন ও পাকিস্তানকে আলাদা রাখা। এখন চিন ও পাকিস্তান এককাট্টা। এত দিন ভারতের দুই সীমান্তে দু’টি লড়াইয়ের ক্ষেত্র থাকলেও এখন সেটাই নিরবচ্ছিন্ন সীমান্তের লড়াই হয়ে উঠেছে। ভারত বিদেশনীতিতে একেবারে বিচ্ছিন্ন এবং সে কারণেই প্রজাতন্ত্র দিবসে কোনও বিদেশি রাষ্ট্রনেতাকে অতিথি হিসেবে পাওয়া যায়নি বলেও রাহুলের দাবি।
এর পাল্টা জবাব দিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। রাহুলকে ‘ইতিহাসের পাঠ’ দিতে চেয়ে বিদেশমন্ত্রী বলেন, ‘‘১৯৭০-এ চিন, পাক অধিকৃত কাশ্মীরে কারাকোরাম হাইওয়ে তৈরি করেছিল। তখন থেকেই দু’দেশের মধ্যে পরমাণু সমঝোতা চলছে। ২০১৩ তে চিন-পাকিস্তান আর্থিক করিডরের কাজ শুরু হয়েছে। তা হলে নিজেকে প্রশ্ন করুন, চিন-পাকিস্তানের মধ্যে কি তখন দূরত্ব ছিল?’’ এ ছাড়া, তাঁর কটাক্ষ, ‘‘ভারতে যাঁরা থাকেন, সকলেই জানেন, করোনার ঢেউ চলছে। মধ্য এশিয়ার যে পাঁচটি দেশের প্রেসিডেন্টের ভারতে আসার কথা ছিল, তাঁরা ২৭ জানুয়ারি ভার্চুয়াল বৈঠকে যোগ দিয়েছেন। রাহুল কি এটাও জানেন না?’’
বাজেট অধিবেশনের গোড়ায় রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার ধন্যবাদজ্ঞাপন প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কে আগেও রাহুল অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু এ বার বিজেপির সাংসদদের বক্তৃতার পরে কংগ্রেসের প্রথম বক্তা হিসেবে তিনি আসরে নামেন। মোদী সরকারকে নিশানা করে উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, মণিপুরের ভোটারদেরও বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। উত্তরপ্রদেশে দলিতদের নিপীড়ন, পঞ্জাবে চাষিদের কৃষি আইন নিয়ে আপত্তি না শোনার অভিযোগ তোলার পরে কংগ্রেস নেতা বলেছেন, অমিত শাহ মণিপুরের মানুষদের অপমান করেছেন। মণিপুরের সাংসদদের প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তাঁদের বাড়ির বাইরেই জুতো খুলতে হয়েছে। কিন্তু অমিত শাহ নিজে চপ্পল পরে বসেছিলেন। রাহুলের প্রশ্ন, ‘‘এ কোন সংস্কৃতি? কোন মানসিকতার প্রতিফলন?’’ রাহুলের বক্তব্য, দু’ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এক হল, ভারত রাজ্যসমূহের সংঘ। কোনও সাম্রাজ্য নয়। আলোচনা না করে, সমঝোতায় না গিয়ে শাসন করা যায় না। অশোক, মৌর্য, গুপ্ত— তিন হাজার বছরের ইতিহাসে তা হয়নি। দ্বিতীয় ধারণা হল, লাঠি হাতে দেশ শাসন। মোদী জমানায় তা-ই হয়েছে।
বিজেপি সাংসদদের দিক থেকে পাল্টা কটাক্ষ উড়ে এসেছে। তার মধ্যেই রাহুল বলেছেন, দেশের সবথেকে বড় সমস্যা, বেকারত্ব নিয়ে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় কোনও উল্লেখ নেই। ধনী, গরিবের ফারাক ক্রমশ বাড়ছে। বিহার, উত্তরপ্রদেশে রেলের চাকরি নিয়ে কী হয়েছে, তা সবাই জানেন। তরুণরা চাকরি খুঁজছেন। কিন্তু সরকার চাকরি দিতে পারছে না। ৫০ বছরে সবথেকে বেশি বেকারত্ব। ইউপিএ সরকারের আমলে ২৭ কোটি মানুষকে দারিদ্রের কবল থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়েছিল। মোদী জমানায় ২৩ কোটি মানুষকে দারিদ্রে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। রাহুল বলেন, ‘‘আরঅএসএস ও বিজেপি দেশের ভিত নিয়ে ছেলেখেলা করছে। তারাই নিশ্চিত করছে যাতে কোনও তরুণ চাকরি না পান।’’