সাংসদ পদ হারাবেন রাহুল? — ফাইল চিত্র।
‘মোদী’ পদবি নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের দায়ে বৃহস্পতিবার গুজরাতের সুরাত জেলা আদালত দু’বছর জেলের সাজা দিয়েছে কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধীকে। তবে পাশাপাশিই রাহুলের জামিনের আবেদন মঞ্জুর করে ৩০ দিনের জন্য সাজা কার্যকর করা স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করেছেন বিচারক এইচএইচ বর্মা। তিনি জানিয়েছেন, ওই সময়সীমার মধ্যে সাজার রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উচ্চতর আদালতে আবেদন করতে পারবেন ওয়েনাড়ের কংগ্রেস সাংসদ রাহুল।
প্রশ্ন উঠেছে সেখানেই। ভারতীয় সংবিধানের ১০২(১) ই অনুচ্ছেদ এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আইন (১৯৫১)-র ৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ হবে, না কি আপাতত তিনি রেহাই পাবেন, তা নিয়ে দানা বেঁধেছে বিতর্ক।
বিজেপির দাবি, নিম্ন আদালত যে হেতু রাহুলকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা ঘোষণা করেছে, কাজেই তাঁর লোকসভার সাংসদ পদ খারিজ হওয়াই উচিত। অন্য দিকে, রাহুলের ঘনিষ্ঠ আইনজীবীরা বলছেন, আদালত সাজা ঘোষণার পাশাপাশি জামিনের আবেদনও মঞ্জুর করেছে। অর্থাৎ, সাজা কার্যকর হচ্ছে না। ফলে উচ্চতর আদালতে জামিনের সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত সাংসদ পদ খারিজের সম্ভাবনা নেই। রাহুলের আইনজীবী বাবু মঙ্গুকিয়া বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘‘নিম্ন আদালত সাজা কার্যকর মুলতুবি রেখে জামিন মঞ্জুরের পরেও জনপ্রতিনিধির পদ খারিজ করা হয়েছে, এমন কোনও নজির নেই।’’
এই পরস্পরবিরোধী দাবির নেপথ্যে রয়েছে ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের দু’টি ধারা। ওই আইনের ৮(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ফৌজদারি অপরাধে দু’বছরের বেশি কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কোনও ব্যক্তি সাজা ঘোষণার দিন থেকেই জনপ্রতিনিধি হওয়ার অধিকার হারাবেন। এবং মুক্তির পর ছ’বছর পর্যন্ত ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না। কিন্তু ওই আইনেরই ৮(৪) ধারায় বলা হয়, সাজা ঘোষণার সময় যদি কেউ জনপ্রতিনিধি থাকেন, তা হলে পরবর্তী তিন মাস বা উচ্চতর আদালতে সাজা পুনর্বিবেচনার আবেদনের নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত তাঁর সদস্যপদ খারিজ হবে না।
জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের এই ৮(৪) ধারার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন লিলি টমাস এবং এস এন শুক্ল। ২০১৩ সালের বিচারপতি এ কে পট্টনায়ক এবং বিচারপতি এস জে মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ ৮(৪) ধারাকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল, নিম্ন আদালত সাজা কার্যকরের নির্দেশ দিলেই ‘অপরাধী’ জনপ্রতিনিধির পদ খারিজ হবে। কিন্তু রাহুলের ক্ষেত্রে সাজা কার্যকর ৩০ দিনের জন্য মুলতুবি ঘোষণা করেছে সুরত জেলা আদালত।
ঘটনাচক্রে, ২০১৩ সালে শীর্ষ আদালতের সেই রায় আটকানোর জন্যই তড়িঘড়ি একটি অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) জারি করতে সক্রিয় হয়েছিল তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। কিন্তু সে সময় রাহুল স্বয়ং সাংবাদিক বৈঠক করে ওই অধ্যাদেশের খসড়া বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলার দাবি তুলেছিলেন (সে সময় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন আমেরিকা সফরে গিয়েছিলেন)। রাহুলেরই চাপে দাগি জনপ্রতিনিধিদের ‘রক্ষাকবচ’ দেওয়ার সেই প্রক্রিয়া বন্ধ করেছিল ইউপিএ সরকার।
ইতিহাস বলছে, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে ফাঁকের সুযোগ নিয়েই নিম্ন আদালতে সাজা পেয়েও বিহারে পাপ্পু যাদব, সাহাবুদ্দিন বা উত্তরপ্রদেশে রাজা ভাইয়ার মতো ‘বাহুবলী’ রাজনীতিকরা বহাল তবিয়তে আইনসভার সদস্য থেকে গিয়েছেন। কিন্তু এক দশক আগে সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়ের পর ‘দাগি’ সাংসদ-বিধায়কদের বরখাস্তের প্রক্রিয়া অনেক দ্রুত হয়। জয়ললিতা, ওমপ্রকাশ চৌটালা থেকে শুরু করে হালফিলের সমাজবাদী বিধায়ক আজম খান, এনসিপি সাংসদ মহম্মদ ফয়জলের মতো অনেকেই রয়েছেন সেই তালিকায়। সেখানে রাহুলের নাম জুড়বে কি না, তা জানার জন্য সম্ভবত অপেক্ষা করতে হবে আরও এক মাস। উচ্চতর আদালতের রায় ঘোষণা পর্যন্ত।