বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়।
মাদ্রাজ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন আচমকা মেঘালয় হাই কোর্টে বদলি করে দেওয়া হল— সুপ্রিম কোর্টের অলিন্দে এই প্রশ্ন গত দু’দিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। মাদ্রাজ হাই কোর্টের আইনজীবীরা আজ সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা ও কলেজিয়ামের অন্য সদস্যদের সেই প্রশ্ন করলেন। মাদ্রাজ হাই কোর্টের ২৩৭ জন আইনজীবী প্রধান বিচারপতি-সহ কলেজিয়ামের সদস্যদের চিঠি লিখে জানিয়েছেন, কেন এক জন যোগ্য ও নির্ভীক বিচারপতিকে বদলি করে দেওয়া হল, আদালতের বারের সদস্য বা আইনজীবীদেরও তা জানার অধিকার রয়েছে। কলেজিয়ামের সিদ্ধান্তে ‘বাইরের চাপ’ কাজ করেছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
সবেমাত্র জানুয়ারি মাসেই কলকাতা হাই কোর্ট থেকে মাদ্রাজ হাই কোর্টে গিয়ে প্রধান বিচারপতি হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুল ও দার্জিলিংয়ের সেন্ট পল’স স্কুলের প্রাক্তনী স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সরকারি ব্যবস্থায় বেচাল দেখলে তোপ দাগছিলেন। গত এপ্রিলে দেশে কোভিডের সংক্রমণ বাড়ছে দেখেও বিধানসভা নির্বাচনে জনসভার অনুমতি দেওয়ার জন্য তিনি নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য নির্বাচন কমিশনকেই দায়ী করে তিনি বলেছিলেন, কমিশনের কর্তাদের বিরুদ্ধে বোধহয় খুনের মামলা দায়ের করা উচিত। তাঁর রায়ের ফলেই কেন্দ্রীয় সরকারকে নিট-এর সর্বভারতীয় কোটায় ওবিসি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। আবার কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি বিধিতে সংবাদমাধ্যমের পোর্টালে নজরদারির চেষ্টার অভিযোগ ওঠায় তিনি বলেছিলেন, এতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হবে। পুদুচেরিতে বিজেপি ভোটারদের আধার তথ্যের অপব্যবহার করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এই সব কারণেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও আইনের স্নাতক বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোপের মুখে পড়তে হয়েছে কি না, আইনজীবী মহলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, মাদ্রাজ থেকে মেঘালয় হাই কোর্টে বদলি একপ্রকার অবনমন বলে মনে করা হচ্ছে। মাদ্রাজ হাই কোর্ট দেশের চতুর্থ বৃহত্তম হাই কোর্ট— ইলাহাবাদ, বম্বে ও পঞ্জাব-হরিয়ানা হাই কোর্টের পরেই। অনুমোদিত বিচারপতির সংখ্যা ৭৫ জন। এই বছরে ৩৫ হাজারের বেশি মামলা দায়ের হয়েছে। তুলনায় মেঘালয় হাই কোর্টের বিচারপতির সংখ্যা মাত্র চার জন। মাসে ৭০ থেকে ৭৫টি মামলা দায়ের হয়।
মাদ্রাজের আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতি-সহ কলেজিয়ামের সদস্যদের কাছে জানতে চেয়েছেন, বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়কে বদলির সিদ্ধান্ত কি জনস্বার্থে না কি ন্যায়বিচারের স্বার্থে? প্রধান বিচারপতি রমণার পাশাপাশি কলেজিয়ামের বাকি সদস্য, বিচারপতি উদয় উমেশ ললিত, বিচারপতি এ এম খানউইলকর, বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি এল নাগেশ্বর রাওয়ের কাছেও এই চিঠি গিয়েছে। আইনজীবী মহলের প্রশ্ন, কলেজিয়াম বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়কে বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৬ সেপ্টেম্বর। ৯ নভেম্বর সেই সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে আনা হল কেন?
মাদ্রাজের আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতিকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছেন, কলেজিয়ামের সিদ্ধান্তগ্রহণ ঘিরে গোপনীয়তা এবং কোনও মানদণ্ড না থাকার ফলে ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বলে ধারণা জন্মায়। এই ধরনের বদলির ফলে দু’রকম জল্পনা তৈরি হয়। এক, বিচারপতির কাজে অসঙ্গতির ফলে তাঁকে বদলি করা হয়েছে কি না। দুই, এই সিদ্ধান্তগ্রহণে কোনও বাইরের বিষয় ঢুকে পড়েছে কি না, বিশেষত যেখানে তেমন প্রভাবের জোরদার ইঙ্গিত রয়েছে। এর ফলে সৎ বিচারপতির ভাবমূর্তি ধাক্কা খায়। মানুষের সামনে বিচারব্যবস্থার ভাবমূর্তিও নষ্ট হয়। চিঠিতে লেখা হয়েছে, বদলির কারণ জানা না গেলে একটাই সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং তা হল— এক জন বিচারপতিকে নির্ভীক ও নিরপেক্ষ ভাবে তাঁর দায়িত্ব পালনের জন্য শাস্তির মুখে পড়তে হল। আইনজীবীদের ব্যাখ্যা, গত দশ মাসে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক পর্যবেক্ষণই কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে ‘অস্বস্তির কারণ’ হয়ে উঠেছে। ফলে সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের সিদ্ধান্তে কেন্দ্রের প্রভাব রয়েছে কি না, সে প্রশ্নও উঠতে পারে। মাদ্রাজের আইনজীবীরা সে দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের বদলির সঙ্গে দু’বছর আগে আর একটি বদলিরও মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। ২০১৯-এ মাদ্রাজ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি বিজয়া কে তাহিলরমানিকে একইভাবে মেঘালয় হাই কোর্টে বদলি করা হয়েছিল। তিনি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়েছিলেন। কিন্তু বদলির নির্দেশ বহাল থাকায় তিনি বিচারবিভাগ থেকেই ইস্তফা দেন। এ বার বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় বদলির নির্দেশ মেনে নেন কি না, সে দিকেও নজর থাকছে দেশের বিচারপতি, আইনজীবী মহলের।