টাটকা-তাজা পাঁচশো টাকার নতুন নোট। নয়াদিল্লির ব্যাঙ্কে। ছবি: পিটিআই
দু’দিন আগে ব্যাঙ্কে দু’ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তুলেছিলেন অদিতি দুবে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রী নতুন দু’হাজার টাকার নোট হাতে সেলফি তুলে ছবিও পোস্ট করেছিলেন ফেসবুকে। তার পরে দু’দিন কেটে গেলেও সেই নোট ভাঙাতে পারেননি। মোবাইলের রিচার্জ করতে গিয়ে খুচরো মেলেনি। মুদি দোকান শর্ত দিয়েছে, অন্তত হাজার দেড়েক টাকার জিনিসপত্র কিনতে হবে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাঁর প্রশ্ন, কষ্ট করে ২০০০ টাকার নোট পেয়ে কী লাভ হল?
একই প্রশ্ন অর্থনীতিবিদদেরও। তাঁরা বলছেন, যারা কালো টাকা নগদে জমা করে রেখেছে, তাদের জব্দ করতেই নরেন্দ্র মোদী সরকার পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করেছে। ২০০০ টাকার নোট চালু হলে তো নগদে টাকা জমিয়ে রাখা আরও সহজ হয়ে যাবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কালো টাকার তদন্তে তৈরি বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)-এরও তাই মত। সিট-এর প্রধান, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম বি শাহ ও বিচারপতি অরিজিৎ পাসায়াত অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে চিঠি লিখে বলেছেন, ‘‘২০০০ টাকার নোট চালু হওয়ায় নগদে বড় অঙ্কের অর্থ জমিয়ে রাখা আরও সহজ হয়ে যাবে। যদি নগদ মজুতের উপর কোনও ঊর্ধ্বসীমা না থাকে, তা হলে পুরনো নোট বাতিলের ফায়দা ধরে রাখা যাবে না।’’ এই মুহূর্তে এমন কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের যুক্তি, পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বদলে দেওয়ার কাজটি দ্রুত সেরে ফেলতে সুবিধা হবে— এই ভেবেই আগে ২০০০ টাকার নোট বাজারে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির জবাব, ‘‘আমরা চাইছিলাম, পুরনো নোটের বদলে দ্রুত নতুন নোট বাজারে পৌঁছে দিতে। তাই ২০০০ টাকার নোট আগে বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়।’’
রবিবারই নাসিকের কারেন্সি নোট প্রেস প্রথম দফায় ৫০ লক্ষ ৫০০ টাকার নোট ছাপিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে পাঠায়। আজ থেকে সেই নোট বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে বিলি করা শুরু হয়েছে। জেটলির ব্যাখ্যা, ব্যাঙ্ক থেকে যে পরিমাণ টাকা তোলা হচ্ছে বা পুরনো নোট বদলে দেওয়া হচ্ছে, সেই চাহিদা ৫০০ টাকার নোট দিয়ে পূরণ করতে অনেক সময় লাগত। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে বিভিন্ন ব্যাঙ্কে একই সঙ্গে অনেক অর্থ পৌঁছে দেওয়া যাবে, এই ভেবেই আগে ২০০০ টাকার নোট বিলি শুরু হয়।
জেটলির ব্যাখ্যা অর্থ মন্ত্রকের একটি সূত্রই পুরোপুরি মানতে রাজি নয়। তাঁদের যুক্তি, অর্থ মন্ত্রকই প্রথমে ঘোষণা করেছিল, পুরনো নোট বদলে দেওয়া হবে নতুন ৫০০ টাকার নোটে। ২০০০ টাকার নোট বাজারে আসবে পরে। বাস্তবে ২০০০ টাকার নোট চালু করার বিষয়ে আগেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিচালন বোর্ডে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই অনুযায়ী, নতুন নোটের নকশা তৈরি করে ছাপাও শুরু হয়ে যায়। তখনই নোটের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেরিয়ে পড়ে। বাজারে ছাড়ার দিন ক্ষণ অবশ্য তখনও ঠিক হয়নি। পুরনো নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত পর নতুন ৫০০ টাকার নোটের নকশা তৈরি, ছাপানোর কাজ শুরু হয় পরে। সে ক্ষেত্রেও গোপনীয়তা রাখতে গিয়ে দ্রুত গতিতে কাজ এগোয়নি। তাই প্রথমে ২০০০ টাকার নোট দিয়েই পরিস্থিতি সামলানোর সিদ্ধান্ত নেয় মোদী সরকার।
ফল হয় উল্টো। পুরনো নোট বদলে নতুন ৫০০ টাকার নোট মিললে তা ভাঙাতে সুবিধা হতো। কিন্তু তার বদলে ২০০০ টাকার নোট হাতে এসে পড়ায় তা খুচরো করতে গিয়ে ভোগান্তি দ্বিগুণ হচ্ছে। এটিএম থেকে নতুন ৫০০ ও ২০০০ টাকার নোট মিলছে না। নতুন নোটের মাপ অনুযায়ী যন্ত্রাংশ ও সফটওয়্যার বদলাতে হবে। তা ছাড়া এটিএম-এ দিনে মাত্র ২০০০ টাকা মিলছে। বেশি টাকা মিলবে বলে যারা ব্যাঙ্কে যাচ্ছেন, তারা ২০০০ টাকার নোট নিতে রাজি হচ্ছেন না। কারণ তা ভাঙানো যাচ্ছে না। এর জেরে ব্যাঙ্কের সামনে লাইন এগোচ্ছে দেরিতে। জেটলির যুক্তি, ‘‘যদি সবাই ২০০০ -এর নোট নিতে শুরু করেন, তা হলে ব্যাঙ্কের সামনে লাইন থাকবে না।’’
প্রশ্ন হল, রোজকার প্রয়োজনে এই ২০০০ টাকার নোট কী কাজে আসবে?
স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারপার্সন অরুন্ধতী ভট্টাচার্যর যুক্তি, ‘‘যে কোনও সংসারে সারা মাসের মুদি দোকানের জিনিসপত্র কিনতেই ২০০০ টাকার বেশি খরচ হয়ে যায়। কাজেই এই নোট চালাতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’’ অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের ব্যাখ্যা, আসলে ২০০০ টাকার নোট হাতে পেয়েই মানুষ সেটা ভাঙানোর কথা ভাবছেন। ২০০ টাকার জিনিস কিনে ২০০০ টাকার নোট দিচ্ছেন। ৫০০ টাকা বাজারে থাকলে তা ভাঙাতে সুবিধা হতো। এ দিকে ১০০ টাকার জোগান কম। যাদের কাছে ১০০ টাকা রয়েছে, তারাও তা হাতছাড়া করতে রাজি হচ্ছেন না। তাতেই ২০০০ টাকার নোট নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। ৫০০ টাকা বাজারে আসতে শুরু করলে সমস্যা কমবে। অর্থ বিষয়ক সচিব শক্তিকান্ত দাসের যুক্তি, ২০০০ সালে ১০০০ টাকার নোট চালু হয়েছিল। মূল্যবৃদ্ধির হার মাথায় রেখে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রস্তাব দিয়েছিল, এখন ৫০০০ ও ১০,০০০ টাকার নোট চালু করা হোক। কিন্তু মোদী সরকার ২০০০ টাকার নোট চালু করতে রাজি হয়। মূল্যবৃদ্ধির হার মাথায় রাখলে ২০০০ টাকার নোট একেবারেই অপ্রয়োজনীয় নয়।