ছ’মাসের দয়িতাপতি। নিজস্ব চিত্র।
শ্রী মন্দিরে সেবায়েতদের ভিড় দেখে প্রথমে ভ্যাঁ করে কান্না জুড়েছিল তারা। কিন্তু ‘অনসর পেন্ডি’তে জগন্নাথদেবের কাছে এসেই খলখল হাসি। কচি হাতে প্রভুর শ্রীঅঙ্গে তেল, চন্দন লেপন দেখে জগন্নাথের ‘সেবায়েত ভাই’ দয়িতাপতিরাও হেসে গড়িয়ে পড়ছেন।
কাল, সোমবার রথযাত্রার প্রাক্কালে জগন্নাথের এই একরত্তি সেবায়েতদের কথাই আলোচনার তুঙ্গে। শনিবার প্রভুর নবযৌবন বেশ দেখতে হাজির অন্য সেবায়েতরাও একেবারে খুদে দয়িতাপতিদের দেখে আহ্লাদে ডগোমগো। ২৯ দিনের অক্ষয়, চার মাসের যমজ সন্তান জগা-বলিয়া আর ছ’মাসের শ্রীঅঙ্গকে কোলে নিতেই কাড়াকাড়ি দশা।
রথযাত্রার প্রাক-পর্বে জগন্নাথদেবের জ্বর থেকে আরোগ্যের সময়টাই প্রভুর বিশেষ সেবায়েত তথা ভ্রাতৃপ্রতিম দয়িতাপতিদের নিয়োগপর্ব। সব বছর অবশ্য নিয়োগ হয় না। মন্দিরের প্রবীণ সেবায়েতরা বলছিলেন, মাত্র ২৯ দিন বয়সে নতুন দয়িতাপতির নিয়োগ শ্রীমন্দিরেও বিরল। জগন্নাথ মন্দিরের আবহমান রীতি অনুযায়ী, স্নানযাত্রার পরে জগন্নাথের অসুস্থতাপর্ব, আরোগ্য, রথে আরোহণ থেকে উল্টোরথের পরে মন্দিরে ফিরে আসা পর্যন্ত সব কিছুর দায়িত্বে থাকেন দয়িতাপতিরা। তাঁরা আদতে আদিবাসী বা শবর বংশোদ্ভুত। জগন্নাথের পুজো চালু হওয়ার প্রাকপর্বে এই শবরেরাই নীলমাধব রূপে তাঁকে পুজো করতেন বলে কথিত। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ পুরোহিতের হাতে মন্দিরে জগন্নাথদেবের পুজো চালু হলেও শবরদের কিছু বিশেষ ভূমিকা থাকে। শবররাজকন্যা ললিতার স্বজাতি হিসেবে তাঁরা দয়িতাপতি নামে পরিচিত। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার অনবসরে (অসুস্থাপর্ব, যা লোকমুখে অনসর বলা হয়) একমাত্র এই দয়িতাপতিদেরই সেবার অধিকার। বংশানুক্রমে নতুন দয়িতাপতি নিয়োগ এই সময়েই হয়ে থাকে।
রথযাত্রার আগে চলছে শেষ মুহূর্তের সাজসজ্জা। শনিবার পুরীতে। ছবি পিটিআই।
মন্দিরের বড়গ্রাহী তথা দয়িতাপতিদের নেতা জগন্নাথ সোঁয়াইন মহাপাত্র বলছিলেন, “স্নানযাত্রার পরে ষষ্ঠী থেকে নতুন দয়িতাপতির নিয়োগ হয়। নবজাতকের ২১ দিন হলেই তারা সেবায়েত রূপে দীক্ষিত হবে।” আর এক জন বড়গ্রাহী দয়িতাপতি রামচন্দ্র দাস মহাপাত্রের কথাতেও, “দয়িতাপতির সেবাভার আমাদের উত্তরপুরুষদের জন্য জন্ম থেকে সংরক্ষিত। দয়িতাপতি হিসেবে দীক্ষার পরে মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে ভাতাও তারা একেবারে শিশু অবস্থাতেই পাবে।’’ এ যাত্রা, চারটি শিশুও যেমন পাচ্ছে। দয়িতাপতি তথা জগন্নাথ মন্দিরের বিভিন্ন সেবায়েতরা এখন অনেকেই স্কুলকলেজে শিক্ষিত। সারা বছর নানা পেশায় কাজ করেন। কিন্তু রথের সময়ে কমবেশি মাসখানেক তাঁরা মন্দিরের হোলটাইমার। রামচন্দ্র দয়িতাপতির ছোট ছেলে ৩৪ বছরের অমিত দাস মহাপাত্র দয়িতাপতির পুত্র ছ'মাসের শ্রীঅঙ্গও এ বার পূর্বপুরুষের সেবা দায়িত্বে শামিল হয়েছে।
জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা সুস্থ হওয়ার পরে অনসরপেন্ডিতে ‘নবযৌবন বেশ’ চলছে শুক্রবার থেকেই। এ বছর তিন দিন ধরে চলবে। এ বার তিন জনের রথও নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তৈরি। তবে কোভিড-বিধি মেনে এ দিনই পুরীতে কার্ফু জারি। প্রবীণ সেবায়েতরা আপশোস করছেন, অন্য সময়ে নবযৌবন বেশ দেখতে লাখো ভক্ত হামলে পড়েন। এ বার শুধু সেবায়েতরা থাকছেন। প্রশাসন, সেবায়েত থেকে ভক্তের একটাই চিন্তা, রথযাত্রা সুষ্ঠু ভাবে সারতে হবে