হাতে বোধিবৃক্ষের চারা, প্রণবের নজরে বাণিজ্য

গুঁয়েন ফু ত্রং তখন ভিয়েতনামের জাতীয় আইনসভার (ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি) চেয়ারম্যান। বুদ্ধগয়ায় এসে বোধি বৃক্ষের নীচে বসতেই, একটি পাতা পড়েছিল তাঁর মাথায়। পরে দিল্লি পৌঁছে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সে গল্প শোনাতেই, চেয়ার ছেড়ে প্রায় উঠে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “করেছেন কী!

Advertisement

শঙ্খদীপ দাস

হ্যানয় (ভিয়েতনাম) শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৪৩
Share:

ভিয়েতনাম সফরের আগে উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি। রবিবার রাষ্ট্রপতি ভবনে। ছবি: পিটিআই

গুঁয়েন ফু ত্রং তখন ভিয়েতনামের জাতীয় আইনসভার (ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি) চেয়ারম্যান। বুদ্ধগয়ায় এসে বোধি বৃক্ষের নীচে বসতেই, একটি পাতা পড়েছিল তাঁর মাথায়। পরে দিল্লি পৌঁছে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সে গল্প শোনাতেই, চেয়ার ছেড়ে প্রায় উঠে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “করেছেন কী! এতো শুভ লক্ষণ! বোধি গাছের পাতা কারও মাথায় পড়লে উনি রাজা হন!”

Advertisement

ফু ত্রং রাজা হননি বটে। কিন্তু ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হওয়াটাই বা কম কীসে! কমিউনিষ্ট ভিয়েতনামের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতা এখন তিনি। চার দিনের ভিয়েতনাম সফরে কাল সোমবার তাঁর সঙ্গে ফের বৈঠক হবে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। তার আগে বুদ্ধগয়ার বোধি গাছের আস্ত একটি চারা নিয়ে আজ হ্যানয় পৌঁছলেন রাষ্ট্রপতি। হ্যানয় শহরের মাঝামাঝি ফরাসি স্থাপত্যে গড়ে তোলা যে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস, তারই উঠোনে কাল আনুষ্ঠানিক ভাবে বোধি-চারাটি পুঁতে দেবেন প্রণববাবু।

প্রতিদানে এ দেশে ভারতীয় স্থাপত্যের নির্দশন সংরক্ষণের অঙ্গীকার করবে হ্যানয়। বস্তুত ভারত-ভিয়েতনাম সম্পর্কের অতীত সহস্র বছরেরও বেশি পুরনো। এখানকার চাম সভ্যতার (চম্পা নগরীর) সঙ্গে ভারতের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচুর মিল রয়েছে। ভিয়েতনামের মাই-সনে তারই স্থাপত্য ও নির্দশন সংরক্ষণের জন্যও চুক্তি সই হবে প্রণবের এই সফরে।

Advertisement

‘সফট ডিপ্লোমেসি’ বা ‘কোমল কূটনীতি’ তো একেই বলে! সে ভাল। কিন্তু আন্তর্জাতিক কূটনীতির আগ্রহ তো শুধু একে নিয়েই নয়। বরং এ-ও প্রশ্ন হল, স্রেফ এই ‘কোমল কূটনীতির’ জন্যই কি ভিয়েতনাম সফরে এলেন প্রণববাবু? নেহাতই প্রতীকী এই সফর! তা হলে উনি যে বলেছিলেন, সরকার বা দেশের কূটনৈতিক প্রয়োজনে বিশেষ কাজ ছাড়া বিদেশ সফরে যাবেন না!

সেই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন ভারতীয় কূটনীতিকরাই। জানাচ্ছেন, বাইরে থেকে যা শুধু আবেগের আবরণ, তারই ভিতরে রয়েছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, আর্থিক ও কৌশলগত স্বার্থের বহু বিষয়। ‘কোমল কূটনীতি’-র মলাট উল্টে ভিতরে তাকালেই একে একে দেখা যাবে সেগুলি। প্রথমেই রয়েছে, ভারত-ভিয়েতনাম তেল ও গ্যাস চুক্তি। ভারতকে আরও দু’টি তেল ও গ্যাসব্লক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হ্যানয়। প্রণবের সফরে পেট্রো ভিয়েতনামের সঙ্গে ওএনজিসি বিদেশের এ ব্যাপারে চুক্তি সই হবে। দুই, দু’দেশের প্রতিরক্ষা সমঝোতা। যার আওতায় ভিয়েতনামের বায়ুসেনা জওয়ানদের সুখোই থার্টি, এম কে টু বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দেবে ভারতীয় বায়ুসেনা। তা ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ব্রাহ্মোস মিসাইল হ্যানয়কে সরবরাহ করবে (পড়ুন বিক্রি করবে) নয়াদিল্লি। তিন, ভিয়েতনামে ভারতীয় শিল্প সংস্থার বিনিয়োগের পথ সুগম করতে আলোচনা চালাবেন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল। ভিয়েতনামে দু’টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তুলতে টাটা গোষ্ঠী ইতিমধ্যেই একশো কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। সেই সঙ্গে ভারতীয় শিল্প সংস্থাগুলি আরও ৮৫টি প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। সর্বোপরি, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও আর্থিক স্বার্থকে সুনিশ্চিত করতে দক্ষিণ চিন সাগরে নিরাপত্তা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে আলোচনা চালাবে উভয় পক্ষ।

আসলে আপাতদৃষ্টিতে রক্ষণশীল হলেও, ব্যক্তি প্রণব মুখোপাধ্যায় বরাবরই মনে করেন, একবিংশ শতকে আন্তর্জাতিক কূটনীতির মূল মেরুদণ্ডই হয়ে উঠবে বাণিজ্য। ইউপিএ জমানায় প্রথমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও পরে বিদেশ এবং অর্থমন্ত্রী হিসাবে সেই দৌত্যই তিনি চালিয়েছেন। আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও কূটনীতির সেই দর্শনে বিশ্বাসী। তিনিও মনে করেন, কূটনীতি ও কৌশলগত সম্পর্কের মেরুদণ্ড হওয়া উচিত বাণিজ্যই। সম্প্রতি জাপান সফরে গিয়ে সম্রাট আকিহিতোকে গীতা উপহার দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সেই সাংস্কৃতিক কূটনীতির আড়ালে জাপানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আর্থিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে মজবুত ভিতের ওপরে দাঁড় করানোকে পাখির চোখের মতো দেখেছেন। আবার জাপানের মাটিতে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কূটনীতিতে চিনকে কঠোর বার্তাও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

সে দিক থেকে মোদী-প্রণবের তালমিলটাও ভারতীয় কূটনীতিতে এখন প্রাসঙ্গিক। কারণ, সাংস্কৃতিক কূটনীতির আড়ালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও কৌশলগত সম্পর্কের প্রসার ঘটানোই রাষ্ট্রপতির ভিয়েতনাম সফরের লক্ষ্য। আর ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত রেখে বেজিংকেও বার্তা দিতে চাইছে নয়াদিল্লি।

তবে ভিয়েতনামের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের ব্যাপারে প্রকাশ্যে মত প্রকাশ করতে চাননি রাষ্ট্রপতি। তাঁর মতে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আবেগ হল বড় অনুঘটক। সেই বুনোট যত মজবুত হবে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক ও আদানপ্রদান তত সহজ হবে। রাষ্ট্রপতির কথায়, “ভিয়েতনামই এক মাত্র দেশ, যার সঙ্গে নয়াদিল্লির সর্ম্পকের শুধুই উন্নতি হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ-সহ অন্য দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ওঠানামা থাকলেও হ্যানয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্কের রেখচিত্র বরাবরই উর্ধ্বমুখী।”

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আশা, দেশ থেকে যে চারাটি উপহার হিসেবে এনেছেন তিনি, ভবিষ্যতে সেটিই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বৃক্ষে পরিণত হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement