হাথরসে যোগী আদিত্যনাথের পুলিশবাহিনীর সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে গেলেন প্রতিমা। ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া ছবি।
ক্যাঁওম্যাঁও-ওয়ালা একটা আপাত দুর্বোধ্য ইংরেজি গানের কলার টিউন শেষ হতে না দিয়েই ফোন তুলে ভাঙা এবং বসে-যাওয়া গলাটা বলল, ‘‘বোলিয়ে স্যর।’’
রবিবার গভীর রাতে টেক্সট মেসেজে জবাব এসেছিল, ‘‘সোমবার সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আমার বুলেটিন আছে। তার পর আমি ফ্রি। তখন যে কোনও সময় আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারব।’’ অতএব সোমবার দুপুর নাগাদ প্রশ্ন করা গেল, এই ভাঙা গলা নিয়ে কী করে প্রভাতী বুলেটিন করলেন? হাসতে হাসতে জবাব এল, ‘‘করে দিলাম। ভালই তো। ন্যাচেরাল লাগল।’’
আসলে ২৯ বছরের প্রতিমা মিশ্র সেটাই করেন, যেটা তাঁর কাছে ‘ন্যাচেরাল’ বলে মনে হয়। যেমন হাথরসে যোগী আদিত্যনাথের পুলিশবাহিনীর সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে যাওয়া। যত ক্ষণ না নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন, তত ক্ষণ মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। তার পর শেষমেশ সেখানে পৌঁছে তবেই দম নেওয়া। ২৯ বছরের সাংবাদিকের কাছে এটাই স্বাভাবিক। ন্যাচেরাল।
জীবনে প্রথম চাকরিই ‘এবিপি নিউজ’-এ। ২০১২ সালে শিক্ষানবিশ সাংবাদিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আট বছর ধরে সেখানেই। তার মধ্যে ছ’বছরই মাঠে-ঘাটে নেমে সাংবাদিকতা। গত দু’বছর ধরে অ্যাঙ্কর হিসেবেও কাজ করছেন (তাঁর প্রভাতী অনুষ্ঠান দর্শকদের কাছে পরিচিত ‘নমস্তে ভারত’ নামে)। কেন তাঁকে ময়দানে ঘুরে ঘুরে সাংবাদিকতার সঙ্গে অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বও দেওয়া হল, সে প্রশ্নের জবাবে অকপট ইলাহাবাদি পিতার কন্যা, জন্মসূত্রে মহারাষ্ট্র্রের কল্যাণের বাসিন্দা, ‘‘আসলে আমি চুপ করে থাকতে পারি না। অনর্গল বকবক করাটা আমার অভ্যাস। তো, অফিস বলল, বকতে যখন এতই ভালবাসো, তখন না-হয় স্ক্রিনেই সেটা করো।’’ তবে কি না, স্ক্রিনের বাইরেও যে তিনি সেটা কত ভাল পারেন, গোটা দেশ তার সরাসরি সম্প্রচার দেখেছে। যেখানে তিনি একটানা লড়ে যাচ্ছেন ‘উল্টাপ্রদেশের’ (উত্তরপ্রদেশের সংক্ষিপ্ত রূপ ‘ইউপি’ হওয়ায় বহু দিন ধরেই এই নাম প্রচলিত। ইদানীং যোগী-আমলে একটু বেশিই ব্যবহৃত) পুলিশের সঙ্গে। তিনি চলছেন। সঙ্গে চলছে তাঁর পদযুগল। তাঁর মুখ। অনর্গল। কখনও তিনি সহযোগী ক্যামেরাপার্সন মনোজ অধিকারীকে বলছেন, ‘‘ক্যামেরা বন্ধ নহি হোনা চাহিয়ে মনোজ! রোল, রোল রোল!’’ পুরো সময়টা তাঁর ‘ইপি’ (ইয়ার প্লাগ) চালু। পুরো সময়টাই তিনি ‘লাইভ’। ফলে একইসঙ্গে তাঁকে সতর্ক থাকতে হয়েছে। পাছে কোনও মাথা-গরম, অসংসদীয় শব্দ না বেরিয়ে পড়ে। প্রতিমা বলছিলেন, ‘‘সারা দেশ থেকে কত লোক যে আমায় ক্রমাগত বলছিলেন, আমার সঙ্গে আছেন! আমার অফিস সারা ক্ষণ বলছিল, বেটা ডাটে রহো। হাম তুমহে বরাবর দেখ রহে হ্যায়। ওতেই হিম্মতটা আরও বেড়ে গিয়েছিল।’’
হিম্মত বলে হিম্মত! সারা দেশের কাছে এখন ‘প্রতিবাদের মুখ’ হয়ে গিয়েছেন তিনি। প্রতিমা নিজেও সেটা বিলক্ষণ জানেন। বললেন, ‘‘এই কভারেজে যে সাহস পেয়েছি, তার কোনও তুলনা হয় না। সারা দেশ জেনে গিয়েছে, কোথাও কোনও অপরাধ হলে আমি তার বিরোধী মুখ হয়ে হাজির হব। আমার অফিসও সেটা জানে।’’ আরও বললেন, ‘‘আমি ওটাকে একটা মিশন হিসেবে নিয়েছিলাম। নিজেকে বলেছিলাম, যত ক্ষণ না ওই পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারি, তত ক্ষণ বাড়ি ফিরব না। শেষমেশ সেটা যে করতে পেরেছি, এটা ভেবেই ভাল লাগছে।’’
এ-ও বোধহয় এক আশ্চর্য সমাপতন যে, রিপোর্টার হিসেবে প্রতিমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্টই ছিল নয়াদিল্লির ‘নির্ভয়া গণধর্ষণ’-এর ঘটনা। তার পরেও প্রতিমা কভার করেছেন বুলন্দশহরে ধর্ষণের ঘটনা। কিন্তু কখনও তাঁর কভারেজ দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও এমন প্রভাব ফেলেনি। প্রতিমা বলছেন, ‘‘আসলে আগে কখনও এ ভাবে সাংবাদিকদের ঘটনাস্থলে পৌঁছতে বাধা দেওয়া হয়নি। নির্ভয়া-কাণ্ডের সময় বুঝতে পেরেছিলাম, কঠিন অ্যাসাইনমেন্টের চ্যালেঞ্জ নিতে পারি। সেই ধারণা থেকেই আমায় হাথরসে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এ ভাবে যে বাধা দেবে পুলিশ, সেটা বুঝতে পারিনি। সেই জন্যই জেদ চেপে গিয়েছিল। রাগও হয়েছিল। অ্যান্ড আই ওয়াজ অ্যাংরি অ্যান্ড অ্যাজিটেটেড অ্যাজ আ ওম্যান টু! সাংবাদিক তো বটেই, মহিলা হিসেবেও প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল। কারণ, আমি সাংবাদিকেরও আগে একজন মহিলা। একটি মহিলার সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে, তা পুলিশ ওই ভাবে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিল বলে আরও রাগ হয়েছিল!’’
নয়ডায় বাবা-মা এবং দিদি-ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন প্রতিমা। দিদি জার্মান আর ফরাসি ভাষার শিক্ষিকা। ভাই বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে ট্যাক্স কনসালট্যান্ট হিসাবে জড়িত। কিন্তু মিশ্র পরিবারের ত্রিসীমানায় কোনও সাংবাদিককে কখনও দেখা যায়নি। কিন্তু প্রতিমা ছোট থেকে ভেবেছিলেন, সাংবাদিকই হবেন। কারণ, তিনি বরাবর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চান। চেয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, সাংবাদিকতাই সেই রাস্তা, যেখানে হাঁটলে সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে। হাথরসের ঘটনার পর তিনি যখন জাতীয় সেলিব্রিটি হয়ে বাড়ি ফিরেছেন, চিন্তিত বাবা জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘‘কী হত যদি তোকে পুলিশে ধরে নিয়ে যেত?’’ প্রতিমা জবাবে বলেছিলেন, ‘‘তোমার মেয়ে কাজ করতে গিয়ে কাউকে ভয় পায় না। তুমিই শিখিয়েছো। তোমার কি মনে হয় না, আমি যা করেছি, ঠিক করেছি?’’ বাবা বলেছিলেন, ‘‘হাঁ বেটা, আই অ্যাম প্রাউড অব ইউ।’’
আরও পড়ুন: হাতে মাইক, মনে জেদ, হাথরসের দুই আসল বীরাঙ্গনা
সাংবাদিকতায় পুরস্কার-পাওয়া কন্যা আপাতত একটি স্টেডি সম্পর্কে আছেন। হাথরসে যখন তাঁর হার না-মানা লড়াই চলছে, প্রেমিকের চিন্তা হয়নি তাঁর জন্য? ফোনের ওপার থেকে উচ্ছ্বল হাসি ভেসে এল, ‘‘কী আর বলব, ওর বন্ধুরা এখন ওকে ফোন করে বলছে, তোর ফ্ল্যাটের নেমপ্লেট থেকে তোর নামটা সরিয়ে প্রতিমার নামটা লিখে দে। এখন থেকে ওর নামেই লোকে তোকে চিনবে! কিন্তু সত্যি বলতে কি, গোটা ঘটনার সময় ও এক বারও আমায় ফোন করেনি। আমি জানি, ও সব দেখছিল। সকলের সঙ্গেই। কিন্তু মাঝখানে একবারও ফোন করে আমায় বিরক্ত করেনি। সব মিটে যাওয়ার পর ফোন করে জানতে চেয়েছিল, ঠিক আছি কি না আর কিছু খেয়েছি কি না।’’
প্রতিমা মিশ্র। ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া ছবি।
সোমবার বিকেলে বলতে বলতে অনর্গল হাসছিলেন সেই মেয়ে, যিনি মনে করেন স্টুডিয়োতে বসে বসে অ্যাঙ্করিং করার চেয়ে মাঠে-ময়দানে ঘুরে কাজ করা অনেক উত্তেজক। অনেক চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু এ ভাবে সকলের কাছে পরিচিত হয়ে গেলে ভবিষ্যতে কাজ করতে কি অসুবিধা হবে না? প্রতিমা আবার হাসলেন, ‘‘কিছু এসে-যায় না। এমন পরিস্থিতিতে পড়লে আই উইল ফাইট এগেইন। লোকে চিনল কি না চিনল, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। আমি খ্যাতির জন্যও ওটা করিনি। আমার মনে হয়েছিল আমায় পরিবারটার কাছে যে করে হোক পৌঁছতেই হবে। আমি সেটা করেছি। ভাল লেগেছে। ভবিষ্যতে আবার করতে হলে আবার করব!’’
কিন্তু এখন লাগছে কেমন?
ভাল। খুব ভাল। ভাঙা গলায় বললেন রবিবার ২৯ বছরে পা-রাখা তরুণী। বললেন, ‘‘কত অচেনা লোক সোশ্যাল মিডিয়ায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন! বলেছেন, আমি হাথরসে সত্যাগ্রহ করেছি। অনেকে লিখেছে ঝাঁসির রানি। অনেকে বলেছে বীরাঙ্গনা। আমার ওই অর্ডার-অর্ডার করে চিৎকার করতে থাকাটা তো ভাইরাল হয়ে গিয়েছে! কিন্তু সবচেয়ে ভাল লেগেছে কী জানেন? সবকিছু মিটে যাওয়ার পর আড়ালে ওই পুলিশরাই বলেছে, ম্যাডাম, হ্যাটস অফ! আপনে দিখা দিয়া। আমরা জানি, আপনি ঠিকই বলছিলেন। আপনি আপনার ডিউটি করছিলেন। কিন্তু কী বলব। আমাদের তো আপনাদের আটকাতে হুকুম দেওয়া হয়েছিল। আমি জবাবে বলেছি, হ্যাঁ, আপনারা আমায় প্রচণ্ড হয়রান করেছেন। কিন্তু আমিও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ওদের সঙ্গে দেখা না করে হাথরস ছাড়ব না! পরেশানি হো সকতা হ্যায়। পর হার নহি মানেঙ্গে!’’
আরও পড়ন: ঝরঝরে বাংলায় তনুশ্রী বললেন, কাউকেই ভয় পাই না। কাজ থামবে না
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, আশ্চর্য নয় যে, রোজ সকালে যে মেয়ে বলেন ‘নমস্তে ভারত’, সেই মেয়েকে গোটা ভারত এখন বলছে— ‘‘নমস্তে প্রতিমা!’’