জাপান সফরে গিয়ে ভারতে আড়াই হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের আশ্বাস আদায় করে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার ক’দিন পরে নয়াদিল্লি সফরে আসেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং। পাঁচ বছরে ২ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে বেজিং। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় এই নিয়ে কি কম আলোচনা হল! তার ওপর নরওয়ে একাই যদি ভারতে ৪ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের স্বপ্ন দেখায়, তা হলে!
এই প্রথম বার গার্ডেরমোয়েন বিমানবন্দরের মাটি ছুঁল কোনও ভারতীয় রাষ্ট্রপতির বিমান। কৈলাস সত্যার্থীকে নরওয়ের নোবেল কমিটি পুরস্কার ঘোষণার ঠিক ৪৮ ঘন্টা পর। মাত্র আড়াই দিনের নরওয়ে সফর, তার পর আরও আড়াই দিন সুমেরুবৃত্ত সংলগ্ন স্ক্যানডিনেভিয়ার অপর রাষ্ট্র ফিনল্যান্ডে যাবেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। আর এ বার তাঁর সঙ্গে রয়েছেন ৪৫ জন শিল্পপতি ও বণিকের এক প্রতিনিধি দল, সেই সঙ্গে শিক্ষাবিদ এবং গবেষকদের একটি বড় টিম।
সাম্প্রতিক কালে কোনও রাষ্ট্রপতি এত বড় প্রতিনিধি দল নিয়ে বিদেশ সফরে গিয়েছেন? প্রশ্ন উঠতেই পারে, নরওয়ে-ফিনল্যান্ড সফরের এত কি মাহাত্ম্য! নরওয়েতে কী আছে! তা ছাড়া প্রণববাবুই তো বলেছিলেন, বিদেশ সফরে বিশেষ যাবেন না! তবে কেনই বা ফের বাইরে এলেন?
কয়েক বছরে নয়াদিল্লি-অসলো সম্পর্কের টানাপোড়েনও সুবিদিত। এক প্রবাসী বাঙালি দম্পতির দুটি শিশুকে অসলোয় তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল নরওয়ের শিশু সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যাকে তাদের বাবা-মা-র কাছে ফিরিয়ে দিতে কূটনীতির কত না কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে নয়াদিল্লিকে! আবার টুজি মামলায় লাইসেন্স খারিজ হওয়ায় নরওয়ের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম সংস্থা টেলিনরের সঙ্কটও তীব্র হয়। তা নিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আঁচ পড়ার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল নরওয়ে। প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।
সেই তিক্ততা মুছতেই কি প্রথম কোনও ভারতীয় রাষ্ট্রপতি নরওয়ে এলেন? শুধু এটুকু রোম্যান্টিকতাই সার! তা হলে এত বড় প্রতিনিধি দল কেন!
ধন্দ ও সংশয় ভাঙাচ্ছেন ভারতীয় কূটনীতিকরাই। সাউথ ব্লকের এক কূটনীতিকের কথায়, তিক্ততার নিষ্পত্তি আগেই হয়েছে। বন্ধুত্বের সম্পর্ককে মজবুত করতে নোবেল শান্তি পুরস্কারের ঘোষণাও অনুঘটকের কাজ করেছে। কিন্তু রোম্যান্টিকতার এই পরিসরের বাইরেও সুমেরুবৃত্ত সংলগ্ন নরওয়ের ও ফিনল্যান্ড সফর থেকে প্রত্যাশার তালিকা দীর্ঘ।
সাউথ ব্লকের কূটনীতিকটি জানালেন, এই সফরে কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব পাবে। যেমন এক, রাষ্ট্রপতির সফরেই অসলো-নয়াদিল্লি পরমাণু নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারে। দুই, তাদের সার্বভৌম তহবিল থেকে ভারতে আরও বিনিয়োগের অঙ্গীকার করতে পারে নরওয়ে। নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এভিন্ড হোমের কথায়, “সার্বভৌম তহবিল থেকে ভারতে বিনিয়োগের পরিমাণ বর্তমানের অন্তত দশ গুণ অর্থাৎ ৪ হাজার কোটি ডলার করতে চায় নরওয়ে।” তিন, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড থেকে ভারী শিল্প, জাহাজ নির্মাণ, উন্নত প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা খাতে প্রত্যক্ষ লগ্নি টানা। এবং এই দুই দেশে ভারতীয় শিল্প সংস্থার বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। সেই কারণেই শিল্পপতি ও বণিকদের প্রতিনিধি দল নিয়ে এসেছেন রাষ্ট্রপতি। চার, ভারতের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণাকেন্দ্রগুলির সঙ্গে নরওয়ে-ফিনল্যান্ডের উন্নত প্রযুক্তি ও গবেষণার আদানপ্রদান। পাঁচ, সুমেরুবৃত্ত অঞ্চলে ভূ-গবেষণার সুযোগ বাড়ানো। সর্বোপরি, সুমেরুবৃত্ত অঞ্চলে ভবিষ্যতে বরফ গললে সমুদ্রপথে সুগম যাতায়াতের সুযোগ নেওয়া, এবং সেখানে সঞ্চিত বিপুল প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল ভাণ্ডারকে ভারতে শক্তি ক্ষেত্রে চাহিদা মেটাতে কাজে লাগানো।
এর পরেও কি বলা যাবে রাষ্ট্রপতির এই সফর নিছকই প্রতীকী! বিদেশ মন্ত্রকের কর্তাদের রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন, সফরে অযথা ঘোরাঘুরির ইচ্ছা তাঁর নেই, বরং গঠনমূলক আলোচনার জন্য যেন বেশি সময় রাখা হয়। সেই ইঙ্গিত পেয়েই নরওয়ের রাজা-রানির সঙ্গে শুধু একটি সংগ্রহশালা ঘুরে দেখার কর্মসূচিও রাখা হয়েছে তাঁর সফরে। আর ফিনল্যান্ডে সান্তাক্লজের গ্রাম ঘুরে দেখবেন রাষ্ট্রপতি।
কর্মসূচির বাকিটা ঠাসা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য।