Population Control

Population Control: সঞ্জয় গাঁধী থেকে যোগী-হিমন্ত, নির্বীজকরণ ও রাজনীতি গত সাত দশক ধরেই মিলেমিশে একাকার

কংগ্রেস হোক বা বিজেপি, পরিবার পরিকল্পনার রাজনীতিকরণ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আদৌ কার্যকর কি না, প্রশ্ন থাকছেই।

Advertisement

পম্পা অধিকারী সিংহ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২১ ১১:৫৫
Share:

অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।

জোর করে নাগরিকদের উপর পরিবার পরিকল্পনা নীতি চাপিয়ে দেওয়া অথবা গর্ভধারণের সংখ্যা বেঁধে দেওয়ার ঘোর বিরোধী সরকার। সাত মাস আগে দুই সন্তান নীতি চালুর আর্জি নিয়ে যখন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন বিজেপি নেতা অশ্বিনীকুমার উপাধ্যায়, সেই সময় শীর্ষ আদালতে হলফনামা জমা দিয়েই এমনই জানিয়েছিল কেন্দ্র। তাতে বলা হয়, ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কার্যকরী পরিবার কল্যাণ কর্মসূচিই যথেষ্ট।’ কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ যখন কার্যত জোর করেই সেই নীতি রূপায়ণে সচেষ্ট হয়েছে, তা নিয়ে টুঁ শব্দটি করছেন না দিল্লিতে শাসকদলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তাতেই নতুন করে প্রশ্ন উঠছে, আসন্ন নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই কি নিশ্চুপ শাসক শিবির? পরিবার কল্যাণ এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে কোটি কোটি মানুষের গার্হস্থ্যে হস্তক্ষেপের এই পরিকল্পনা কি পুরোপুরি ভাবেই রাজনৈতিক?

Advertisement

গত ১১ জুলাই, বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে প্রস্তাবিত বিলটি প্রকাশ করেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। বিপুল জনসংখ্যা উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সমস্ত নাগরিক সমান সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না বলেই দুই সন্তান নীতি কার্যকর করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি। বিলটিতে সাফ বলা হয়েছে, যাঁরা দুই সন্তান নীতি মানবেন না, সরকারের সমস্ত কল্যাণমূলক প্রকল্প থেকে বাইরে রাখা হবে তাঁদের। সরকারের কাছ থেকে কোনও ভর্তুকি পাবেন না তাঁরা। ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না। আবেদন করতে পারবেন না সরকারি চাকরির জন্যও। তাঁদের পরিবারের মাত্র চার সদস্যকেই রেশন কার্ড দেওয়া হবে। কিন্তু যাঁরা সরকারি নীতি মেনে ‘স্বেচ্ছা’য় নির্বীজকরণ করাবেন, দুইয়ের বেশি সন্তানধারণ করবেন না, তাঁদের পদোন্নতি, বেতনবৃদ্ধি, করছাড়ের মতো সুবিধা পাবেন। সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং পেনশনে তিন শতাংশ বেশি টাকা দেওয়া হবে।

২০২১ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক বিবাহিত পুরুষ (২১ বছর) এবং মহিলাদের (১৮ বছর) গর্ভধারণের অনুপাত ২.১ শতাংশে নামিয়ে আনতেই এই উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জয়প্রতাপ সিংহ। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১৫-’১৬ বর্ষের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত দশকে উত্তরপ্রদেশে মহিলা পিছু গর্ভধারণের হার কমেছে বই বাড়েনি। ওই বছর রাজ্যে গর্ভধারণের হার ছিল ২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে তা নেমে আসে ২.১ শতাংশে এবং গ্রামাঞ্চলে ৩ শতাংশে। ২০১৯-’২০ সালের পরিসংখ্যানে অন্য রাজ্যগুলির উল্লেখ থাকলেও, উত্তরপ্রদেশের কোনও উল্লেখ নেই। রিপোর্ট বলছে ১৯৯৯ সালের ৪.০৬ শতাংশ থেকে উত্তরপ্রদেশে গর্ভধারণের হার যেখানে ১.৩৬ শতাংশ কমেছে, সেখানে ওই ১৭ বছরে গোটা দেশে গর্ভধারণের হার মাত্র ০.৭ শতাংশ কমেছে।

Advertisement

পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতই প্রথম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হয়।

তা হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নতুন বিল আনার প্রয়োজন পড়ল কেন? বিরোধীদের দাবি, প্রকাশ্য মঞ্চে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে নিত্যনতুন দাবি করতে অভ্যস্ত যোগী। সামনে ভোট। তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে তাঁর সরকার সংখ্যালঘুদের কোণঠাসা করতে নেমে পড়েছে এবং রাজনৈতিক স্বার্থেই বিজেপি নেতৃত্ব এ নিয়ে নীরবতা পালন করছেন। তবে ভোটের উত্তরপ্রদেশ তো বটেই, হিন্দি বলয়ের একটা বড় অংশ বারবরই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে রাজনৈতিক সিদ্ধিলাভের শিকার হয়েছে বলে মত সমালোচকদের। তাঁদের অভিযোগ, যোগী সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেও, কংগ্রেসই আসলে তাদের পথপ্রদর্শক।

স্বাধীনতার পর যখন ছিন্নমূল মানুষদের পুনর্বাসন দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার, সেই সময় ১৯৫১ সালে দৃষ্টান্তমূলক ভাবে ভারতই প্রথম পাঁচ বছরের জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা নেয়। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা কোয়ার্জের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, সংক্রামক রোগে আক্রান্তদের নির্বীজকরণের প্রথা যদিও ঢের আগে থেকেই প্রচলিত ছিল দেশে। কিন্তু সাতের দশকে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, রাতের পর রাত বাড়ির বাইরে থাকতে শুরু করেন তাঁরা, যাতে সরকারের লোকজন এসে জোর করে নির্বীজকরণে বাধ্য না করে। টিকিট না কেটে ট্রেনে উঠলে জরিমানার বদলে নির্বীজকরণে রাজি করিয়ে যাত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও সামনে আসতে থাকে। তার জেরে গণপরিবহণ এড়িয়ে চলতে শুরু করেন পুরুষরা। এর প্রভাব পড়ে পোলিয়োর মতো রোগের টিকাকরণেও। কৌশলে সরকার নির্বীজকরণ করিয়ে দিতে পারে এই আতঙ্কে শিশুদেরও টিকা দেওয়াতেন না সাধারণ মানুষ।

তবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সার্বিক সাড়া মেলে ইন্দিরা গাঁধীর আমলে। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সরকারের ‘হম দো হমারে দো’ নীতি। কিন্তু তাঁর আমলেই জরুরি অবস্থার সময় হিন্দি বলয়ের প্রান্তিক মানুষের জীবনে তা কার্যত ত্রাসে পরিণত হয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে জোর না দিলে খাদ্যের জোগান বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে ১৯৬৫ সালে ভারতকে কার্য়ত হুঁশিয়ারি দেন আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন। বিশ্বব্যাঙ্ক, ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড পেরেন্টস ফেডারেশন, রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফেও চাপ বাড়তে থাকে। যে কারণে এ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির পরিবর্তে নির্বীজকরণে জোর দেয় সরকার। তার জন্য লক্ষ্যও বেঁধে দেওয়া হয় কিন্তু সরকারি কর্মী এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের। সেই লক্ষ্যপূরণ করতে গিয়েই কার্যত জোর করে নির্বীজকরণের রাস্তা নেন তাঁরা যা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলে।

নির্বীজকরণ থেকে বাঁচতে সত্তরের দশকে কার্যত পালিয়ে বেড়াতেন পুরুষরা।

সেই সময়, সরকারি কোনও পদে অধিষ্ঠিত না থাকলেও, ইন্দিরার উত্তরসূরি হিসেবে অলিখিত ভাবেই নথিভুক্ত হয়ে যান তাঁর ছেলে সঞ্জয় গাঁধী। সমালোচকদের মতে, সঞ্জয়ের হাত ধরেই গণ নির্বীজকরণের রাজনীতিকরণ ঘটে। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, শুধু এই যোগ্যতায় পরিবার পরিকল্পনা রূপায়ণে নেমে পড়েন তিনি। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রে নির্বীজকরণ বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন বলে সাফ জানিয়ে দেন সঞ্জয়। ঘনিষ্ঠ মহলে এ নিয়ে আপত্তি জানালেও সঞ্জয়কে বাধা দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করেননি তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী কর্ণ সিংহ। তাতে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে সঞ্জয়ের নির্দেশকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশ বলে মানতে শুরু করেন কংগ্রেস কর্মীরা। এমনকি বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও তাঁর পরামর্শ মেনে চলতে শুরু করেন। কার্যত সঞ্জয়কে তুষ্ট করতেই একে একে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা, পঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ এমনকি ওড়িশার মতো রাজ্যেও নির্বীজকরণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।

জরুরি অবস্থার আগে পর্যন্ত পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাজ্যগুলির হাতে ছিল। কিন্তু ১৯৭৬ সালে সেই আইন পাল্টে গিয়ে গোটা বিষয়টিই কেন্দ্রের হাতে চলে যায়। নির্বীজকরণে উৎসাহিত করতে উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের মতো রাজ্যে প্রায়শই জনসভা করতেন সঞ্জয়। লক্ষ্যপূরণ করতে পারলে স্বর্ণপদক পাওয়ার আশ্বাস পেতে শুরু করেন পুলিশ কমিশনাররা। নিজে নির্বীজকরণ করালে এবং অন্যদেরও রাজি করাতে পারলে, পদোন্নতির আশ্বাস দেওয়া হয়। বেতন পেতে, গাড়ি চালানোর শংসাপত্র পেতেও নির্বীজকরণের শংসাপত্র জমা দেওয়ার রীতি চালু হয়। সেই সময়, প্রথম দিকে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্য শিবিরে দৈনিক প্রায় ৩৫০ নির্বীজকরণ অস্ত্রোপচার হতো। ক্রমশ সেই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৬ হাজার ৫০০-য় পৌঁছে যায়।

কিন্তু যত সময় এগোতে থাকে, এ নিয়ে ভূরি ভূরি অভিযোগ জমা হতে থাকে। দরিদ্র, নিরক্ষর, কয়েদি, ফুটপাতবাসী, হাসপাতালের রোগীদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্বীজকরণ করানো হচ্ছে বলে অভিযোগ আসতে থাকে। যে সমস্ত পড়ুয়াদের মা-বাবা নির্বীজকরণ করাননি, তাঁদের অযথা আটকে রাখার ঘটনাও উঠে আসে। এমনকি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, অনভিজ্ঞ স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতে অস্ত্রোপচার করিয়ে সংক্রমিত হয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন বহু মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুদের নির্বীজকরণে জোর দিতে শুরু করেন সঞ্জয়। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, হিন্দু অধ্যূষিত এলাকায় শুধু সামাজিক ভাবেই নয়, অর্থনৈতিক ভাবেও কোণঠাসা হয়েছিলেন সংখ্যালঘুরা। নির্বীজকরণের পিছনে আসলে তাঁদের জনসংখ্যা বাড়তে না দেওয়ার অভিসন্ধি রয়েছে বলে মনে করতেন তাঁরা। যে কারণে সংখ্যালঘুদের নির্বীজকরমে বিশেষ জোর দেন সঞ্জয়। তাঁর ধারণা ছিল, সংখ্যালঘুদের উৎসাহিত করতে পারলে বাকিরা নিজে থেকেই এগিয়ে আসবেন। তার জন্য সংখ্যালঘু সংম্প্রদায়ের মহিলাদের পরিবার ছোট হওয়ার ভাল দিক বোঝাতে শুরু করেন কংগ্রেস কর্মীরা।

কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়।। শুধুমাত্র ১৯৭৫ সালেই নির্বীজকরণের বিরোধিতায় ২৪০টি হিংসার ঘটনা সামনে আসে। প্রয়াত সাংবাদিক তথা মানবাধিকার কর্মী কুলদীপ নায়ার তাঁর ‘দ্য জাজমেন্ট: ইনসাইড স্টোরি অব এমারজেন্সি ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে তার উল্লেখ করেছেন। উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুরের নার্কাডিহ গ্রাম থেকে নির্বীজকরণের জন্য কয়েক জনকে কার্যত তুলে এনেছিলেন সেখানকার তৎকালীন কমিশনার। তা থেকে বাঁচতে পুলিশের উপর চড়াও হন গ্রামবাসীরা। আত্মরক্ষায় গুলি চালাতে বাধ্য হয় পুলিশ। তাতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। অনেকে জখম হন। মুজফ্‌ফরনগরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। সেখানে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় ২৫ জনের। জরুরি অবস্থার সময় নির্বীজকরণের অস্ত্রোপচারে সংক্রমিত হয়ে এবং নির্বীজকরণের বিরোধিতা করতে ঠিক কত জনের মৃত্যু হয়, তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর এ নিয়ে হাজার হাজার মামলা জমা পড়েছিল আদালতে।

সেই সময় জন সঙ্ঘ এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ম সেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) নির্বীজকরণের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। কিন্ত জন সঙ্ঘ ভেঙে তৈরি হওয়া বিজেপির সরকারই এখন উত্তরপ্রদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘স্বেচ্ছা’য় নির্বীজকরণের প্রস্তাব নিয়ে নয়া আইন চালু করতে তৎপর হয়েছে। শুধু তাই নয়, দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী কেউ যদি একটি সন্তানধারণ করে নির্বীজকরণ করিয়ে নেন, তা হলে তাঁকে এককালীন মোটা টাকা দেওয়ার প্রস্তাব এনেছে। ছেলের জন্মের পর নির্বীজকরণ করালে মিলবে ৮০ হাজার টাকা। মেয়ের জন্মের পর নির্বীজকরণ করালে ১ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। শুধু উত্তরপ্রদেশই নয়, বিজেপি শাসিত কর্নাটক, অসম, গুজরাতও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিল আনার পরিকল্পনা শুরু করেছে। কর্নাটক যদিও ইতিমধ্যেই গর্ভধারণের হার কাঙ্ক্ষিত ২.১-এ পৌঁছনোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে ফেলেছে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা খোলাখুলি জানিয়েছেন, মুসলমান অধ্যূষিত এলাকাগুলিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অভিযান চালানো হবে। তাঁর দাবি, ‘‘২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত অসমে হিন্দুদের জনসংখ্যা যদি ১০ শতাংশ বেড়ে থাকে, মুসলমানদের জনসংখ্যা বেড়েছে ২৯ শতাংশ। জনসংখ্যা কম বলেই অসমে হিন্দুদের জীবনধারণের মান উন্নত। খোলামেলা বাড়ি, গাড়ি রয়েছে তাঁদের। হিন্দুদের ছেলেমেয়েরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছেন।’’

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সবরকমের নিরোধক বিলি করা হবে বলে এক হাজার ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সেনা’ নামানো হবে বলেও জানিয়েছেন হিমন্ত। নিরাপদ গর্ভপাতের ব্যবস্থা করা হবে, জায়গায় জায়গায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা হবে বলে জানিয়েছে উত্তরপ্রদেশ সরকারও। কিন্তু এতে বিপদ বাড়বে বই কমবে না বলে মত মানবাধিকার ও সমাজকর্মীদের একাংশের। তাঁদের মতে, কন্যাভ্রূণ হত্যার হার ভারতেই সবচেয়ে বেশি। সরকারের তরফে চেষ্টা করা হলেও, উত্তরের বেশ কিছু রাজ্যে বেআইনি ভাবে জন্মের আগে লিঙ্গ নির্ধারণ পরীক্ষা রমরমিয়েই চলছে। এই ধরনের আইন চালু হলে কন্যাসন্তান দেখে গর্ভপাতের ঘটনা আরও বাড়বে বলেই মত তাঁদের। লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে কাজ করা পপুলেশন ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া সংস্থার একজিকিউটিভ ডিরেক্টর পুনম মাত্রেজা সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘‘গোটা দেশে বা শুধু উত্তরপ্রদেশে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটছে, এমন কোনও তথ্যপ্রমাণ কিন্তু নেই। সে জাতীয় হোক বা আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান, কোনও ক্ষেত্রেই এমন উদ্বেগের কোনও ইঙ্গিত মেলেনি।’’

দুই সন্তান নীতিতে কন্যভ্রূণ হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা।

উত্তরপ্রদেশ সরকার জানিয়েছে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনসংখ্যায় ভারসাম্য আনতেই এই বিল প্রয়োজন। জনসংখ্যার ভারসাম্যের অংশটিই সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে মনে করছেন আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তথা বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী অলকা বসু। একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘‘বৃহত্তর অ্যাজেন্ডার কাজে তো বটেই, বিশেষ কোনও সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব অথবা বিশেষ কোনও সম্প্রদায়কে সাজা দিতে এই নীতির অপব্যবহার হতে পারে।’’ উত্তরপ্রদেশের পড়শি রাজ্য বিহারে বিজেপি-র শরিক নীতিশ কুমারও যোগী সরকারের এই উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রত্যেক রাজ্যই স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে আমার মতে, আইন এনে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মহিলাদের শিক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে। তা হলেই সচেতনতা তৈরি হবে। গর্ভধারণের হারও কমবে।’’ বিজেপি-র শাখা সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি)-ও এই বিলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। একটি সন্তানের অংশটি বিল থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা। রাজ্য আইন কমিশনকে চিঠি লিখে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অলোককুমার জানিয়েছেন, এতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনসংখ্যায় ভারসাম্যহীনতাই দেখা দেবে।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের অভিযোগ।

তবে সমালোচনা সত্ত্বেও নিজেদের অবস্থানে অনড় যোগী সরকার। সংসদে দলের সাংসদ তথা অভিনেতা রবি কিষাণকে দিয়ে খসড়া বিলটি ‘প্রাইভেট মেম্বার্স বিল’ হিসেবে পেশ করাতে চলেছে তারা, যিনি নিজে চার সন্তানের বাবা। প্রাইভেট বিল অন্য বিলের চেয়ে আলাদা। মন্ত্রী পদে না থাকা সাংসদরা ওই বিল পেশ করতে পারেন। তবে সেটি গৃহীত হবে কি না, তা নিয়ে কোনও ভোটাভুটি হয় না। রাজ্যসভার চেয়ারম্যান এবং লোকসভার স্পিকারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। তবে খসড়া বিলটি পাশ করাতে গেলে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমর্থন প্রয়োজন। বিজেপি-র তরফে আগেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই ধরনের একাধিক খসড়া বিল জমা পড়েছে। তবে বিলটি সংসদে উঠলেও তা আইনে রূপান্তরিত হতে বিজেপি সাংসদদের সমর্থন প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে মোদী সরকারের অবস্থান কী হয়, তা নিয়ে কৌতূহল দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, জরুরি অবস্থার পর ইন্দিরা সরকারের পতনের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল জোরপূর্বক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের জন্য কেন্দ্র এত বড় ঝুঁকি নেবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান কেউ কেউ। তবে সংসদে উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা যে হেতু সর্বোচ্চ (৮০), তাই ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে বিজেপি বিলটিতে অনুমোদন দিলে আশ্চর্যের কিছু নেই বলে মনে করছেন অনেকেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement