রাহুল গান্ধী এবং নরেন্দ্র মোদীর করমর্দন। বুধবার সংসদ ভবনে। ছবিঃ পিটিআই।
অষ্টাদশ লোকসভার স্পিকার হিসেবে আজ ধ্বনিভোটে বেছে নেওয়া হল ওম বিড়লাকেই। লোকসভার নেতা নরেন্দ্র মোদী এবং বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী, দু’জনে করমর্দন করে স্পিকারকে নিয়ে গিয়ে তাঁর আসনে বসালেন। এ পর্যন্ত সব কিছু ঠিক থাকলেও, তাঁর প্রথম বক্তব্যেই বিরোধী শিবিরের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে ওম বিড়লা যে ভাবে ইন্দিরা গান্ধীর সময়ের জরুরি অবস্থার উল্লেখ করলেন, তা থেকে স্পষ্ট, সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হল শুরু থেকেই।
গত লোকসভার অধিবেশন যে যুদ্ধং দেহি অবস্থানে শেষ হয়েছিল, আজ কার্যত সেখান থেকেই নতুন লোকসভার অধিবেশন শুরুর ইঙ্গিত পাওয়া গেল। শাসক, বিরোধী ও স্পিকার— তিন শিবিরের বক্তব্য ও শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দিয়েছে, লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরছেন না কোনও পক্ষই। রাজনীতির অনেকের মতে, এ দিন বোঝা গিয়েছে, মোদী তৃতীয় বারেও নিজের মতো করেই লোকসভা চালাতে ইচ্ছুক। স্পিকারের বার্তা, প্রয়োজনে গত বারের মতো সাংসদদের সাসপেন্ড করতে পিছপা হবেন না তিনি। আর বিরোধী নেতা রাহুল বুঝিয়ে দিলেন, আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তি থাকায় সংঘাতে প্রস্তুত বিরোধীরাও।
প্রায় চার যুগ পরে আজ ধ্বনিভোটে স্পিকার নির্বাচিত হলেন ওম বিড়লা। আজ প্রধানমন্ত্রী তাঁর নাম স্পিকার হিসেবে প্রস্তাব করলে পাল্টা কংগ্রেস সাংসদ কে সুরেশের নাম প্রস্তাব করেন শিবসেনা (উদ্ধব) দলের সাংসদ অরবিন্দ সবন্ত। তবে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস নেতৃত্ব ডিভিশন না চাওয়ায় বোতাম টিপে ভোটাভুটি হয়নি। ধ্বনিভোটেই ওম বিড়লাকে চলতি লোকসভার স্পিকার হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এরপরেই প্রথামতো বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীকে ডেকে নেন কেন্দ্রীয় সংসদীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। স্পিকারের আসনের দিকে এগিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী। প্রথমে ওম বিড়লার সঙ্গে করমর্দন করেন মোদী। তারপর রাহুল করমর্দন করেন স্পিকারের সঙ্গে। শেষে প্রধানমন্ত্রী এবং রাহুল হাত মেলান। পরবর্তী ধাপে তাঁরা দুজনে স্পিকারকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দেন। স্পিকার হিসেবে দ্বিতীয় বার দায়িত্ব নেন ওম বিড়লা।
তবে সৌহার্দ্যের ওই ছবি ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত সংঘাতের ইঙ্গিতই স্পষ্ট হয়েছে লোকসভায়। গত লোকসভায় সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী স্বরকে ‘দমন করে’ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশের অভিযোগ উঠেছিল। এ বারেও বিল পাশের প্রয়োজনে তা করা হবে বলে ইঙ্গিত দেন প্রধানমন্ত্রী। গত লোকসভায় অসংসদীয় আচরণের জন্য প্রায় দেড়শো সাংসদকে সাসপেন্ড করেছিলেন ওম বিড়লা। যা নিয়ে সংসদে আজ সরব হয়েছিলেন তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ একাধিক সাংসদ।
আজ ওম বিড়লার সেই পদক্ষেপের পক্ষে সওয়াল করে মোদী বলেন, ‘‘সংসদে নিয়ম মেনে চলার প্রশ্নে আপনাকে কখনও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আমি জানি, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আপনাকে ব্যক্তিগত ভাবে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু লোকসভার মর্যাদা ও ব্যক্তিগত কষ্টের মধ্যে আপনি বরাবরই সংসদের মর্যাদাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ওই সাহসী কাজের জন্য আপনাকে অভিনন্দন।’’ অর্থাৎ বিরোধীদের সমালোচনা সত্ত্বেও সাংসদদের সাসপেন্ড করার মতো কড়া সিদ্ধান্ত যদি চলতি লোকসভাতেও নিতে হয়, তা নেওয়া হবে।
আজ দায়িত্ব নিয়ে নিজের প্রথম বক্তব্যে স্পিকারও বুঝিয়ে দিয়েছেন, প্রথম বারের ধাঁচেই লোকসভা চালানোর পথে হাঁটতে চলেছেন তিনি। এ বারে এনডিএ জোটের শক্তিহ্রাস, বিশেষ করে বিজেপি সাংসদদের লোকসভায় আড়েবহরে কমে যাওয়া, উল্টো দিকে বিরোধীদের লোকসভায় সংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও নিজের কর্মপদ্ধতি বিশেষ পাল্টানোর পক্ষপাতী নন তিনি। তাই বক্তব্যের গোড়াতেই জরুরি অবস্থা জারির সমালোচনায় সরব হন তিনি। বিরোধীরা ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখালেও, তাতে কর্ণপাত করেননি তিনি। আবার বিরোধীরা যখন গত লোকসভার ধাঁচে সাসপেনশনের পুনরাবৃত্তি না করার দাবি করছেন, তখন স্পিকারের পাল্টা মন্তব্য, ‘‘আপনারা কী ধরনের মন্তব্য করছেন, তাও মাথায় রাখতে হবে।’’
শক্তিশালী বিরোধী শিবিরও যে শাসক শিবিরকে ছেড়ে কথা বলবে না, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন রাহুল গান্ধী-অখিলেশ যাদবেরা। আজ স্পিকারকে নিরপেক্ষ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন এসপি নেতা অখিলেশ। তিনি বলেন, ‘‘গণতন্ত্রের আদালতে আপনি প্রধান বিচারপতি। লোকসভা যেন আপনার কথায় চলে। অন্যের কথায় যেন আপনাকে চলতে না হয়।’’ শাসক দলকেও যেন স্পিকারের আসন থেকে শাসন করা হয়, সেই দাবি তুলেছেন অখিলেশ। অখিলেশের কথায়, ‘‘স্পিকারের আসনে বসে নিরপেক্ষতা বজায় রাখাই সবচেয়েবড় গুরুদায়িত্ব।’’
আজ স্পিকারের ভূমিকার প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, ‘‘গত লোকসভায় কাজ হয়েছে প্রায় ৯৭ শতাংশ। যা রেকর্ড।’’ সাফল্যের সেই সংজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করতে ছাড়েননি রাহুল। তিনি বলেন, ‘‘প্রশ্ন হল, ভারতবাসীর মনের কথা কতটা লোকসভায় বলতে দেওয়া হল। বিরোধীদের আওয়াজকে নীরব করে সংসদ চালানো অগণতান্ত্রিক ধারণা। এ বারের নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে, দেশবাসী চান, বিরোধীরা সংবিধানকে রক্ষা করুন। আমরা নিশ্চিত যে বিরোধীদের লোকসভায় বলার, ভারতের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার অনুমতি দিয়ে, সংবিধান রক্ষার প্রশ্নে আপনার দায়িত্ব পালন করবেন।’’