প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
আত্মহত্যা কি ঠাট্টা-মশকরা করার মতো বিষয়? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে একযোগে অধিকাংশ বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজের বড় অংশ এই প্রশ্নই তুলছে। রাহুল এবং প্রিয়ঙ্কা গান্ধী থেকে শুরু করে তৃণমূল-আপ-শিবসেনা-এসপি-আরজেডি— সকলেরই দাবি, প্রধানমন্ত্রী হয়ে আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ বিষয়কে নিয়ে হাসিঠাট্টা করা খুবই অসংবেদনশীলতার পরিচয়।
ঘটনাটি বুধবারের। একটি সংবাদমাধ্যম আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছিলেন মোদী। সেখানে সাংবাদিকদের ভাল হিন্দি বলার উপরে জোর দিতে গিয়ে তিনি একটি চুটকি বলেন। চুটকির উপজীব্য হল, এক অধ্যাপকের মেয়ে সুইসাইড নোট লিখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সেই নোট যখন অধ্যাপক বাবার চোখে পড়ল, তিনি বানান ভুল ধরতে ব্যস্ত রইলেন। মোদীর এই চুটকি-সহ গোটা বক্তৃতাটিই টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার তা নিয়েই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে একাধিক বিরোধী দল। তাদের বক্তব্য, আত্মহত্যা তথা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে দেশবাসীর সামনে তামাশা করলে অত্যন্ত ভুল বার্তা যায় বলেই তাঁদের অভিযোগ। বিশেষত ভারতের মতো দেশে, যেখানে আত্মহত্যার পরিসংখ্যান রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর নথি বলছে, ২০২১ সালে ভারতে আত্মহত্যা করেছেন এক লক্ষ ৬৪ হাজার ৩৩ জন। মৃতদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ, সঠিক ভাবে বললে, ৩৪.৫ শতাংশেরই ১৮ থেকে ৩০-এর মধ্যে বয়স। এই সব পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন বিরোধী নেতা-নেত্রীদের অনেকেও। প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা যেমন মুখ খুলেছেন একেবারে প্রথম দিকেই। লিখেছেন, ‘‘অবসাদ-আত্মহত্যা, বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে, কোনও ভাবেই হাসির ব্যাপার নয়।’’ তার পরেই এনসিআরবি-র তথ্য তুলে ধরে বলেছেন, ‘‘২০২১ সালে যে এক লক্ষ ৬৪ হাজার ৩৩ জন আত্মহত্যা করেছেন, তার মধ্যে একটা বড় অংশেরই বয়স ৩০-এর কম। এটা একটা ট্র্যাজেডি, তামাশা নয়।’’ প্রিয়ঙ্কা আরও বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নিজে এবং প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে যাঁরা হো হো করে হাসলেন, তাঁরা বরং নিজেদের একটু শিক্ষিত করুন। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অসংবেদনশীল, অসুস্থ মশকরা না করে সচেতনতা বাড়ান।’’ রাহুল হিন্দিতে লিখেছেন, ‘‘হাজার হাজার পরিবার আত্মহত্যার জেরে তাদের সন্তান হারিয়েছে। তাদের নিয়ে মজা করা ঠিক নয়।’’ তৃণমূল কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে টুইট করা হয়েছে, ‘‘উনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী! মিস্টার নরেন্দ্র মোদী মানসিক স্বাস্থ্য আর আত্মহত্যাকে হেয় করে মজা করছেন! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ২০১৭ সালে ভারতে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল এক লক্ষ ২৯ হাজার ৮৮৭। সেটা বেড়ে ২০১২-এ হয়েছে এক লক্ষ ৬৪ হাজার ৩৩ জন। এটা কঠোর বাস্তব, হাসির কথা নয়।’’
শিবসেনা সাংসদ প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদীও শেয়ার করেছেন এনসিআরবি-র তথ্য। বলেছেন, ‘‘আমি প্রধানমন্ত্রীর ভিডিয়োটা শেয়ার করব না। প্রধানমন্ত্রী আত্মহত্যা নিয়ে চুটকি বলছেন আর লোকে হাসছে!’’ দর্শকদের আমোদের দিকে আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন আরজেডি-র সাংসদ মনোজ কুমার ঝা-ও। বলেছেন, ‘‘চুটকিটা বলার পর যে হাসি আর হাততালির রোল উঠল, সেটা আরও বেশি ভয়ের। আমরা একটা অসুস্থ সমাজে পরিণত হচ্ছি।’’ সমাজবাদী পার্টির গৌরব প্রকাশ তুলে ধরেছেন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট, যেখানে বলা হচ্ছে, ভারতে প্রতি ৯ মিনিটে এক জন করে মেয়ে আত্মহত্যা করেন। আম আদমি পার্টি মন্তব্য করেছে, ‘‘যখন প্রধানমন্ত্রীকে আত্মহত্যার মতো বিষয় নিয়ে মশকরা করতে হয়, বুঝতে হবে মানুষের জীবনের প্রতি আসলে তাঁর অমর্যাদা কতখানি।’’
রাজনীতিকদের পাশাপাশি সরব হয়েছেন নেটিজেনরাও। তাঁদের অনেকেরই মতে, ভাল হিন্দি বলার কথা বলতে গিয়ে এই চুটকির অবতারণা কেন আদৌ প্রয়োজন হল, তা স্পষ্ট নয়। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, সেই জগতের লোকজনও যথেষ্ট ক্ষুব্ধ গোটা ঘটনায়। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলেন, “আত্মহত্যা নিয়ে রসিকতা করলে নিজের কাছে নিজেরই লজ্জা হওয়া উচিত। এমন রসিকতা কুরুচিকর, ছিটেফোঁটা সংবেদনশীলতারও অভাব রয়েছে এখানে।” প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক উপল চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর মতো এক জন ক্ষমতাবান ব্যক্তি সমাজের একটা বিপন্ন অংশকে নিয়ে রসিকতা করছেন, সেটা খুবই নিষ্ঠুর। কী নিয়ে ঠাট্টা করা যায় আর যায়না, প্রধানমন্ত্রীর মতো লোকের তা ভাবা উচিত।’’