স্বাধীনতা দিবসে বক্তৃতা নরেন্দ্র মোদীর। ছবি: পিটিআই।
দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা খাতে আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে ‘এক দেশ এক কার্ড’ চালু করার সিদ্ধান্ত নিল কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। করোনা অতিমারির আবহে লালকেল্লায় শনিবার স্বাধীনতা দিবসের বক্তব্যে স্বাস্থ্যকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ‘ন্যাশনাল ডিজিটাল হেলথ মিশন’ প্রকল্পের ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। এই প্রকল্পে যাঁরা নাম লেখাবেন, তাঁদের একটি জাতীয় স্বাস্থ্য-কার্ড বা পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। যেখানে ওই ব্যক্তির স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য জমা থাকবে। যা সেই ব্যক্তির চিকিৎসার প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবেন চিকিৎসকেরা।
জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি (২০১৭)-এর লক্ষ্য ছিল, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল ও প্রযুক্তিনির্ভর করে তোলা। সেই মতো জাতীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিত ওই ডিজিটাল নীতিকেই ২০১৮ সালে মঞ্জুরি দেয় নীতি আয়োগ। সেই সময় নীতি আয়োগ জানিয়েছিল, গোটা ব্যবস্থাটি প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় এতে ভুল চিকিৎসার প্রবণতা কমবে ও সার্বিক ভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবা উন্নত হবে। দায়বদ্ধতা বাড়বে চিকিৎসক ও গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থার। গত বছর থেকেই ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্রকল্পের পাইলট প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে পুদুচেরি, দাদরা ও নগরহাভেলি, দমন ও দিউ, চণ্ডীগড়, আন্দামান-নিকোবর, লক্ষদ্বীপের মতো ছ’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। শনিবার সেই প্রকল্পকেই গোটা দেশে চালু করার ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী।
এই প্রকল্পে যাঁরা নথিভুক্ত হবেন, তাঁদের প্রত্যেকের পরিচয়পত্রে আধারের মতো একটি করে সংখ্যা থাকবে। সেটিই হবে সেই ব্যক্তির ইউনিক আইডি। আধার কার্ডে যেমন কোনও ব্যক্তির ঠিকানা ও শারীরিক গঠনের বিবরণ জমা থাকে, তেমনই ওই জাতীয় স্বাস্থ্য পরিচয়পত্রে ওই ব্যক্তির চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য জমা থাকবে। প্রতিটি পরিচয়পত্র যুক্ত থাকবে জাতীয় ডিজিটাল হেলথ মিশনের তথ্যভান্ডারের সঙ্গে। পরিচয়পত্রের আইডি-র মাধ্যমে ওই ব্যক্তির চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য তথ্যভান্ডারে যুক্ত করতে পারবেন চিকিৎসক, হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলি। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, কোনও ব্যক্তি যত বার চিকিৎসক বা ওষুধের দোকানে যাবেন, তত বার সেই ব্যক্তির চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য তথ্যভান্ডারে জমা হতে থাকবে। ফলে কোনও ব্যক্তি কোন চিকিৎসক দেখাচ্ছেন, তিনি কী ওষুধ খাওয়ার সুপারিশ করছেন— সেই সব তথ্য কার্ডে জমা থাকবে। ফলে পরবর্তী সময়ে চিকিৎসকদের চিকিৎসা করতে সুবিধে হবে বলেই মত স্বাস্থ্যকর্তাদের। ওই কার্ডটিকে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের সঙ্গেও জোড়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
লালকেল্লায় মোদীর বক্তব্য এক ঝলকে
করোনাসঙ্কট
• বিশেষ সময়ের মধ্যে রয়েছি আমরা। লালকেল্লার মাঠে আজ শিশুদের দেখতে পাচ্ছি না।
• দেশের সেবায় নিয়োজিত কোভিড-যোদ্ধারা ‘সেবা পরম ধর্ম’ মন্ত্রটিকে জাগিয়ে তুলেছেন।
আত্মনির্ভর ভারত
• আত্মনির্ভরতার গুরুত্ব বুঝিয়েছে করোনা। ১৩০ কোটি ভারতবাসীর মন্ত্র করে তুলেছে একে।
• সরব হতে হবে স্থানীয় পণ্যের জন্য (ভোকাল ফর লোকাল)।
• ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র পাশাপাশি নতুন মন্ত্র হোক ‘মেক ফর ওয়র্ল্ড।
পরিকাঠামো
• পরিকাঠামোর উন্নয়নে সরকার ১০০ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করার কথা ভাবছে। ৭০০০ প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে।
• মাল্টি মোডাল কানেক্টিভিটি তথা বহুমুখী যোগাযোগ পরিকাঠামো তৈরির পরিকল্পনা হয়েছে।
কল্যাণ প্রকল্প
• গরিব কল্যাণ যোজনা অভিযান গ্রামে কর্মসংস্থান দিচ্ছে। ৭ কোটি গরিব পরিবারকে বিনামূল্যে গ্যাস সংযোগ, ৮০ কোটিকে বিনামূল্যে খাদ্য, মানুষের ব্যাঙ্ক-খাতায় ৯০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। ৬ হাজার জনৌষধি কেন্দ্র থেকে এক টাকায় স্যানিটারি ন্যাপকিন পেয়েছেন ৫ কোটি মহিলা।
জাতীয় শিক্ষানীতি
• নতুন ভারত গড়তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এর জন্য প্রণীত হয়েছে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি।
অপটিক্যাল ফাইবার
• আগামী ১০০০ দিনের মধ্যে দেশের প্রতিটি গ্রামকে জুড়বে অপটিক্যাল ফাইবার।
ডিজিটাল স্বাস্থ্য মিশন
• প্রত্যেক দেশবাসীকে দেওয়া হবে ডিজিটাল স্বাস্থ্য কার্ড।
ভারত-চিন সংঘর্ষ
• লাদাখে বিশ্ব দেখেছে, ভারতের সেনা কী করতে পারে। বিশ্ব ভারতের পাশে।
অযোধ্যার রামমন্দির
• অযোধ্যায় রামন্দিরের শিলান্যাস হল ক’দিন আগে। শান্তি ও সৌভ্রাত্র রক্ষার জন্য সকলকে অভিনন্দন জানাই।
করোনা অতিমারির কারণে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে টেলিমেডিসিন ও ই-ফার্মেসি পরিষেবা। স্বাস্থ্য কার্ডেও পরবর্তী ধাপে ওই সুবিধাগুলি অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবা হয়েছে। তবে আধার কার্ড সংক্রান্ত আইনি জটিলতার কথা মাথায় রেখে এই ব্যবস্থা ঐচ্ছিক হবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তাঁর কথায়, এই প্রকল্পে যুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। কোনও ব্যক্তি, নাগরিক বা চিকিৎসক যদি ইচ্ছুক হন, তবেই তাঁরা ওই প্রকল্পে জুড়তে পারেন। মোদীর মতে, এই কার্ডটি হবে ডিজিটাল। ওয়েবসাইট ছাড়াও অ্যাপ নির্ভর ওই পরিষেবা শুরু করার কথা ভাবা হয়েছে। ফলে ওই ব্যবস্থা সরকারের ডিজিটাল ভারত গড়ার প্রকল্পকেও গতি দেবে।
এক কার্ডেই চিকিৎসার তথ্য
• মূল প্রস্তাব: ২০১৭ সালে
• লক্ষ্য: একটি কার্ডের মধ্যে প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে রাখা। যাতে তা ওই ব্যক্তির চিকিৎসায় কাজে লাগে।
• কী ভাবে কাজ করবে: প্রত্যেককে আধারের মতো ইউনিক সংখ্যা দেওয়া হবে। সেই নম্বরের মাধ্যমে ওই ব্যক্তির সেই ব্যক্তির স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্ত তথ্যাদি তথ্যভাণ্ডার থেকে এক ঝলকে দেখে নিতে পারবেন চিকিৎসকেরা।
• পরিকল্পনা রূপায়ণের দায়িত্বে: ন্যাশনাল হেল্থ অথরিটি (এনএইচএ)
• বাধ্যতামূলক: না। আধারের অভিজ্ঞতা থেকে এটি ঐচ্ছিক রাখা হচ্ছে।
• তথ্য চুরি: আধারের মতোই সুরক্ষিত থাকবে এই তথ্য। যদিও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, স্বাস্থ্যবিমা সংস্থাগুলি ওই তথ্যের ফায়দা নিতে পারে। বেআইনি ভাবে ফায়দা নেওয়ার সুযোগ থাকতে পারে নার্সিংহোম ও ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির কাছে।
• প্রাথমিক বাজেট: ৪৭০ কোটি
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সরকারের ওই উদ্যোগকে প্রশংসা করলেও ব্যক্তির স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য কতখানি সুরক্ষিত থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। কংগ্রেস নেতা রণদীপ সুরজেওয়ালা বলেন, অতীতে আধারের তথ্য ফাঁসের মতো ঘটনা আমরা দেখেছি। ফলে সংশয় থেকেই যায়। অনেকেই মনে করছেন, ওই তখ্যভাণ্ডারকে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে অপব্যবহার করতে পারে ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা ও স্বাস্থ্য বিমা সংস্থাগুলি। এক দশক আগে নিজেদের দেশে এমনই একটি প্রকল্প চালু করেছিল ব্রিটেন। কিন্তু প্রকল্প খরচ এত বেড়ে যায় যে, শেষে ওই প্রকল্প বাতিল করতে হয় ব্রিটেনকে। তাই প্রশ্ন উঠেছে ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে নামছেন তো মোদী সরকার? না হলে আগামী দিনে ভারতের অবস্থা ব্রিটেনের মতো হতে পারে বলেই মনে করছেন বিরোধীরা।