পিঙ্কি ভিরানি ও অরুণা শানবাগ (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।
কর্মক্ষেত্রে অতর্কিতে হামলা। আর তার পরে নৃশংস যৌন নির্যাতন। যার জেরে জীবনের বাকি ৪২টি বছর ‘ভেজিটেটিভ’ অবস্থায় কাটানো। মু্ম্বইয়ের হাসপাতালের বিছানায় প্রায় মিশে যাওয়া অরুণা শানবাগকে দেখতে দেখতে তাঁর সঙ্গে ‘আত্মিক যোগ’ অনুভব করেছিলেন পিঙ্কি ভিরানি। বিচলিত পিঙ্কি চেয়েছিলেন, সম্মানজনক নিষ্কৃতি-মৃত্যুর অনুমতি পান বন্ধু অরুণা।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক-ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনা আরও এক বার নাড়িয়ে দিয়েছে পিঙ্কিকে। তিনি বলছেন, ‘‘ভারতীয় পরিবারগুলির এ বার কিছু করার সময় এসেছে। নইলে তাদের ঘরের ছেলে ধর্ষক হয়ে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে— এই দৃশ্য তাদের বার বার দেখতে হবে।’’
১৯৭৩ সালের নভেম্বর। ডিউটি শেষ করে পোশাক বদলাতে মুম্বইয়ের কেইএম হাসপাতালের বেসমেন্টে গিয়েছিলেন সেখানকার নার্স অরুণা। সে সময়েই তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হাসপাতালের এক সাফাইকর্মী। গলায় কুকুর বাঁধার চেন জড়িয়ে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। গলায় চেন দেওয়ার কারণে দীর্ঘক্ষণ মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছয়নি অরুণার। দৃষ্টিশক্তি হারান। বাকি ৪২টি বছর তাঁর কেটেছিল ওই হাসপাতালেরই চার নম্বর ওয়ার্ডে শুয়ে। ২০০৯ সালে অরুণাকে ‘মুক্তি’ দিতে আদালতের কাছে নিষ্কৃতিমৃত্যুর আর্জি জানিয়েছিলেন পেশায় লেখিকা ও সাংবাদিক পিঙ্কি। সেই আর্জি গৃহীত না হলেও এ দেশে নিষ্কৃতি-মৃত্যু নিয়ে ভাবনাচিন্তার পথ সুগম হয়।
‘অরুণা’স স্টোরি’, ‘বিটার চকোলেট’ বইয়ের লেখিকা পিঙ্কি অধুনা কানাডার টরন্টোনিবাসী। তবে দেশের খবর রাখেন। আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদের জোয়ার যে ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে, সেই খবর পৌঁছেছে পিঙ্কির কানেও। বলছেন, ‘‘ভয়ঙ্কর ঘটনা। আর কত এরকম ঘটনা ঘটলে তবে প্রশাসক বুঝবেন যে, কর্মক্ষেত্রে আজও মেয়েরা সুরক্ষিত নয়। সরকার বার বার ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দেখায় বা দেখাতে চায়। কখনও হাসপাতালের বেসমেন্টে, কখনও হাসপাতালের সেমিনারকক্ষে, কখনও তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা থেকে বাড়ি ফেরার পথে— সবই নাকি বিচ্ছিন্ন! কিন্তু বাস্তব হল, সকল কর্মরত মেয়েরই কাজে যাওয়া-আসার পথে, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অধিকার আছে।’’
বছর পঁচিশের অরুণার উপরে কর্মক্ষেত্রে হামলার ঘটনার প্রায় বছর বারো পরে প্রথম তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন পিঙ্কি। খানিকটা পেশাগত প্রয়োজনেও। তার পরে অরুণার সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ গড়ে ওঠে তাঁর। দেখেছিলেন, কী ভাবে না মরেও বেঁচে রয়েছেন পরিবার-পরিত্যক্ত নির্যাতিতা। তাই আইনি পথে তাঁকে নিষ্কৃতি দিতে চেয়েছিলেন পিঙ্কি। তবে নারী নির্যাতনের প্রশ্নে এ দেশে আইনের কড়াকড়ি থাকলেও তার সময়মতো যথাযথ প্রয়োগ হয় না বলেই মনে করছেন পিঙ্কি। ‘‘এই জন্যেই ধর্ষকেরা সাহস পায়। তাই যারা বার বার ধর্ষণ করার স্পর্ধা দেখায় বা নির্যাতিতাকে কোমা বা ভেজিটেটিভ স্টেটের মতো পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়, সেই সব ক্ষেত্রে ফাঁসির পক্ষেই সওয়াল করব। নির্ভয়া-কাণ্ডের পরে আইন প্রণয়নের সময়ে এটা নিশ্চিত করতে অনেকটা লড়তে হয়েছিল আমাকে’’— বলছেন অরুণার বন্ধু।
অরুণার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত শোভনলাল ভর্তা বাল্মীকিকে মাত্র সাত বছরের কারাদণ্ডের সাজা শুনিয়েছিল আদালত। ধর্ষণ, অস্বাভাবিক যৌন নির্যাতনের মতো ঘোরতর অপরাধের ধারা তার বিরুদ্ধে আনা হয়নি। ২০১২ সালের দিল্লি গণধর্ষণ-কাণ্ডের অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে নাবালক ছাড়া বাকিদের ফাঁসির হুকুম হয়। পিঙ্কির পর্যবেক্ষণ, ‘‘কোনও ধর্ষণের ঘটনায় ক্যামেরার সামনে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা ফাঁসির কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবে ক’টা ফাঁসি হয়, তাঁরা জানেন? আমি জানি, ক্ষমাভিক্ষা অথবা যাবজ্জীবনের আড়ালে বেঁচে যায় কত ধর্ষক। আর নির্যাতিতারা চলে যান বিস্মৃতির আড়ালে।’’
অরুণার উপরে হামলার পাঁচ দশক পরেও যে কর্মক্ষেত্রে আজও সুরক্ষিত নন মেয়েরা— তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ২০২৪-এর আরজি কর। কেন? ইমেলে পিঙ্কি লিখেছেন, ‘পুরুষ হয়ে ওঠার পথে একটি ছেলের মানসিকতা তৈরি হয় তার বাড়ি, বন্ধুবান্ধব, পরিবেশ থেকেই। সেটাই তাকে শেখায়, মেয়েদের সম্মতি বলে কিছু হয় না। প্রতিনিয়ত জাত-ধর্ম-লিঙ্গভিত্তিক নিগ্রহের সামনে সে নিজেকে একই সঙ্গে নির্যাতিত এবং ক্ষমতাবান বলে ভাবে। হয়তো সে নিজেও ছেলেবেলায় যৌন নিগ্রহের শিকার। তাই মেয়েদের ‘না মানে না’— এটা প্রথম থেকেই শেখাতে হবে প্রতিটি ছেলেকে।’
তার পরেও নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারবেন মেয়েরা? পিঙ্কি বলছেন, ‘‘দুঃখের কথা, কর্মস্থলেও নিরাপত্তার জন্য লড়াই করতে হয় মেয়েদের। তাই তো নিরাপত্তার দাবিতে মধ্যরাতের রাজপথে নামতে হয় মেয়েদের। নির্যাতিত এক জন ছেলে হলে কিন্তু পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যেত।’’