নিউ ইন্ডিয়া সমাচার পত্রিকার সেই প্রচ্ছদ।
স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হয়েছিল ১৮৬৩ সালে। তাঁর জন্মের ছয় বছর আগে, ১৮৫৭ সালেই ঘটে গিয়েছিল সিপাহি বিদ্রোহ। তবে নরেন্দ্র মোদী সরকারের দাবি, স্বামী বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক জাগরণের ফলেই সিপাহি বিদ্রোহ ঘটেছিল!
কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রকের অধীন প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরো মোদী সরকারের কাজকর্মের প্রচারে ‘নিউ ইন্ডিয়া সমাচার’ নামক পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করে। সেই পত্রিকায় স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব বিষয়ে ‘নতুন ভারতের অমৃত যাত্রা’ নামক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে ‘ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা’ শীর্ষক অংশে লেখা হয়েছে, ‘ভক্তি আন্দোলনই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা করেছিল। ভক্তি যুগে স্বামী বিবেকানন্দ, চৈতন্য মহাপ্রভু, রমণ মহর্ষি আধ্যাত্মিক জাগরণ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। এটাই ১৮৫৭-র বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করেছিল।’
ইতিহাসবিদেরা বলছেন, ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনও সম্পর্কই নেই। ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার বলেন, “ভক্তি আন্দোলন হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, মন্দির-মসজিদের নিয়ন্ত্রণ, জাতপাতের ভেদাভেদের বিরুদ্ধে। সেখানে কখনও স্বাধীনতা বা সশস্ত্র আন্দোলনের কথা বলা হয়নি।” স্বামী বিবেকানন্দের মতো তামিল ধর্মগুরু রমণ মহর্ষিরও জন্ম সিপাহি বিদ্রোহের অনেক পরে, ১৮৭৯ সালে। নেট-দুনিয়ার নাগরিকদের কটাক্ষ, স্বামী বিবেকানন্দ কি টাইম মেশিনে চড়ে সিপাহি বিদ্রোহের আগের ভারতে হাজির হয়েছিলেন! কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের কটাক্ষ, ‘ছদ্ম-ইতিহাসবিদেরাই মোদী জমানায় পণ্ডিত হিসেবে সমাদর পান।’
ইতিহাসবিদ ও বিরোধী রাজনীতিকরা অবশ্য একে নিছক তথ্যের বিকৃতি হিসেবে দেখতে রাজি নন। ইতিহাসবিদদের মতে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে আরএসএস, হিন্দু মহাসভার কোনও ভূমিকা ছিল না। তাই মুঘল বা মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু শাসকদের লড়াইকেও স্বাধীনতা আন্দোলনের তকমা দিয়ে বিজেপি নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চাইছে। আর কংগ্রেস বলছে, বিজেপি এই ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের একচ্ছত্র ভূমিকা লঘু করতে চাইছে।
প্রশ্ন উঠেছে, তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রকের অধীন প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর আধিকারিকেরা ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সিপাহি বিদ্রোহের সম্পর্ক কী ভাবে খুঁজে পেলেন?
সরকারি সূত্রের বক্তব্য, খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই এই তত্ত্বের প্রবক্তা। গত ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী ডাণ্ডি অভিযানের বর্ষপূর্তির দিন থেকে স্বাধীনতার ৭৫-তম বর্ষ বা অমৃত মহোৎসবের উদ্যাপনের সূচনা করেন। সেই অনুষ্ঠানেই তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের শিখা জ্বালিয়ে রাখার কাজটি করেছিলেন দেশের সন্ত, মহন্ত, আচার্যরা। একদিক থেকে ভক্তি আন্দোলনই গোটা দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত তৈরি করেছিল।’
ইতিহাসবিদেরা বলছেন, ভক্তি আন্দোলনের সময় পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী। তখনও পলাশীর যুদ্ধই হয়নি। স্বাধীনতা আন্দোলন তো অনেক দূরের কথা। তনিকা বলেন, “এটা আসলে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কালকে আরও পিছনে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা। যাতে মুঘলদের বিরুদ্ধে হিন্দু শাসকের লড়াইকেও স্বাধীনতা আন্দোলন হিসেবে দেখানো যায়।”
বস্তুত, সরকারি পত্রিকার ওই নিবন্ধে স্পষ্ট ভাষাতেই লেখা হয়েছে, ‘স্বাধীনতা আন্দোলন শুধু ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ ছিল না। তার আগেও ভারত দাসত্বের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।’ উত্তরপ্রদেশের রাজা সুহেলদেব, যিনি ব্রিটিশ জমানার অন্তত ৮০০ বছর আগে এক মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তাঁকেও ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ওই নিবন্ধে। সরকারের বক্তব্য, ‘এই সব অনামী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপরে প্রচারের আলো সরানোর লক্ষ্যে অমৃত মহোৎসব উদ্যাপন শুরু হয়েছে।’
বিরোধীদের অভিযোগ, নিজেদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রচারেই বিজেপি-আরএসএস স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে ভক্তি আন্দোলনের আধ্যাত্মিক জাগরণকে জুড়ে দিতে চাইছে। এখন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রতিষ্ঠায় মোদী জমানাতেও সেই আধ্যাত্মিক জাগরণ হচ্ছে বলে বিজেপি-আরএসএস নেতারা বোঝাতে চাইছেন। সরকারি পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ‘এখন অমৃত কালে দেশে আবার আধ্যাত্মিক জাগরণ হচ্ছে। এই আধ্যাত্মিক জাগরণই ভারতের পুনর্নির্মাণের ভিত হিসেবে কাজ করবে।’
অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক শ্রীনাথ রাঘবনের মতে, “ভারতের ইতিহাসকে এই ভাবে হিন্দু, মুসলিম, ব্রিটিশ যুগে ভাগ করাটা একেবারেই জেমস মিলের মতো ব্রিটিশ ইতিহাসবিদদের বই থেকে তুলে আনা।” আর তনিকা বলছেন, মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু শাসকদের লড়াইকে কোনও ভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা যায় না। মুঘল বাহিনীতে হিন্দু, মুসলিম সবাই ছিলেন। তাঁদের হাতে হিন্দু, মুসলিম, সব ধর্মের চাষি, গরিব মানুষই নিপীড়িত হয়েছেন। সেটা একেবারেই শাসক ও শোষিতের ইতিহাস। প্রধানমন্ত্রী কিছু দিন আগে ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে শিবাজির লড়াইয়ের কথা বলেছেন। কিন্তু শিবাজিও মুসলিম শাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। আবার ঔরঙ্গজেবের বাহিনীতে বহু পদস্থ সেনাকর্তা হিন্দু ছিলেন।